ই-পেপার | শুক্রবার , ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

আরসা’র সামরিক কমান্ডার নূর মুহাম্মদ র‍্যাব’র জালে: বিপুল অস্ত্র ও ৫ সহযোগী গ্রেপ্তার

শাহ মুহাম্মদ রুবেল

কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী ‘আরসা’র শীর্ষ সন্ত্রাসী নূর মুহাম্মদ (২৮) র‍্যাবের জালে ধরা পড়েছেন। সেই সাথে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তার আরও ৫ সহযোগীকে। এ সময় তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি অস্ত্র ও গোলাবারুদ জব্দ করা হয়।

শুক্রবার (২১ জুলাই) রাতে টেকনাফ উপজেলার শামলাপুর ও বাহারছড়ার গহীন পাহাড়ি এলাকায় সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

 

গ্রেপ্তার নূর মুহাম্মদ মিয়ানমারের আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সামরিক কমান্ডার। উখিয়া উপজেলার কুতুপালং এলাকার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ‘আরসা’র সামরিক কমাণ্ডার হিসেবে কাজ করতেন তিনি। নূর মুহাম্মদের বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণসহ একাধিক মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছে র‍্যাব।

 

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, সন্ত্রাসী সংগঠন ‘আরসা’র শীর্ষ সন্ত্রাসী হাফেজ নূর মুহাম্মদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অন্যান্য সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে টেকনাফের শামলাপুর-বাহারছড়ার গহিন পাহাড়ি এলাকায় অভিযানে নেমে আরও ৫ জন ‘আরসা’ সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

 

গ্রেপ্তার অন্যরা হলেন- ধলা মিয়ার পুত্র মুহাম্মদ হোসেন জোহার (৩০), ওবায়দুর রহমানের পুত্র মুহাম্মদ ফারুক ওরফে হারেস (২৩), জেবর মুলক ওরফে জমলুকের পুত্র মনির আহমদ (৩৬), অলি আহমদের পুত্র নুর ইসলাম (২৯) ও মুহাম্মদ হোসেনের পুত্র মুহাম্মদ ইয়াসিন (২১)।

 

র‌্যাব জানায়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, গ্রেফতারকৃতরা জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক এবং পাশ্ববর্তী দেশের সন্ত্রাসী সংগঠন ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’ (আরসা) এর শীর্ষ নেতা ও সক্রিয় সদস্য। গ্রেফতারকৃত হাফেজ নুর মুহাম্মদ জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক। তিনি উখিয়া উপজেলার কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের অন্যতম সামরিক কমান্ডার হিসেবে ‘আরসা’র নেতৃত্ব প্রদান করতেন। তার নেতৃত্বে ‘আরসা’র ৩০-৩৫ জন সদস্য কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প ও তার পাশ্ববর্তী এলাকাসমূহে খুন, অপহরণ, ডাকাতি, মাদক, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন ধরণের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনা করে থাকে। সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য তারা পাশ্ববর্তী দেশ হতে দূর্গম সীমান্তবর্তী অঞ্চল দিয়ে অস্ত্র চোরাচালান করতো বলে জানা যায়। গ্রেফতারকৃত হাফেজ নুর মুহাম্মদ তার দলের সদস্যদের মাধ্যমে শরণার্থী শিবির ও স্থানীয় জনগণের নিকট হতে খুন, অপহরণ ও গুমের ভয় দেখিয়ে চাঁদা দাবি করতো। চাঁদার অর্থ না পেলে ভিকটিমকে অপহরণপূর্বক শারীরিক ও পাশবিক নির্যাতনসহ মুক্তিপণ আদায় করতো। মুক্তিপণ না পেলে তারা ভিকটিমকে খুন করে গহীন পাহাড়ে অথবা জঙ্গলে লাশ গুম করতো বলে জানা যায়। সীমান্তবর্তী অঞ্চল দিয়ে ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরণের মাদক বাংলাদেশে পরিবহণ এবং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির ও সংলগ্ন এলাকাগুলোতে সংরক্ষণের কাজে মাদক ব্যবসায়ীদের নির্দিষ্ট চাঁদার বিনিময়ে এই সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্যরা সহযোগিতা করতো বলে জানা যায়। তারা সন্ত্রাসী কার্যক্রম শেষে পাহাড়ী গহীন জঙ্গলে আত্মগোপনে চলে যেতো। তাদের অত্যাচারে শিবিরের শরণার্থীরা সবসময় ভীত সন্ত্রস্ত থাকতো। কেউ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে তাকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করতো বা অপহরণের পর লাশ গুম করতো বলে জানা যায়। তারা বেশ কয়েকদিন ধরে আত্মগোপনের উদ্দেশ্যে টেকনাফ উপজেলার শামলাপুরে অবস্থান করছিল বলে জানা যায়।

র‌্যাবের তথ্যমতে, গ্রেফতারকৃত হাফেজ নুর মুহাম্মদ (২৯) জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মায়ানমারের নাগরিক। ২০১৬ সালে সে ‘আরসা’ সদস্য আরিফ উদ্দিনের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ‘আরসা’ এ যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনি সেকশন কমান্ডারের দায়িত্ব পান। আরসার সামরিক শাখার প্রধান ওস্তাদ খালেদের সাথে তার বিশেষ সখ্যতা ও নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে বলে জানা যায়। তিনি কুংফুতে ব্ল্যাক বেল্ট প্রাপ্ত ও বিস্ফোরক তৈরীতে পারদর্শী এবং আরসা’র অন্যান্য সদস্যদের কুংফু প্রশিক্ষণ দিতেন। তিনি আরসা’র সামরিক শাখার প্রধান ওস্তাদ খালেদের কাছ থেকে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ ও আরসা’র মূল সংগঠক আরিফ উদ্দিন @ হাসেম @ কুইল্লা’র কাছ থেকে বোমা তৈরীর প্রশিক্ষণ নেন। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং শরণার্থী হিসেবে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প-৮ এ অবস্থান করতে থাকেন নুর মুহাম্মদ। প্রাথমিকভাবে তিনি ক্যাম্প-৮ এ আরসার হেড জিম্মাদার হিসেবে দায়িত্ব পান। তার নেতৃত্বেই কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের আরসার সদস্যরা খুন, টার্গেট কিলিং, অপহরণ, ডাকাতি, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ধরণের অপরাধ কর্মকান্ড পরিচালনা করে আসছিলেন। এই নূর মুহাম্মদ ইতিপূর্বে হেড মাঝি শফি উল্লাহ হত্যাকান্ড, সালাম হত্যাকান্ড, সলিম হত্যাকান্ড, মালেক হত্যাকান্ড, হাবুইয়া হত্যাকান্ড, ইমান হত্যাকান্ড, আবুল মুনসুর হত্যাকান্ড, সালেহ হত্যাকান্ড, জোরপূর্বক এক মহিলার ঘরে প্রবেশের সময় মহিলা বাধা দিলে তাকে গুলি করে হত্যাকান্ড এবং সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আলোচিত ৬ জন হত্যাকান্ডসহ বিভিন্ন হত্যাকান্ডে সরাসরি জড়িত। সন্ত্রাসী সংগঠন আরসা’র জন্য চাঁদা সংগ্রহ এবং আরসা’র শীর্ষ নেতাদের নিকট থেকে প্রাপ্ত অর্থ ক্যাম্পের জিম্মাদারদের মাঝে বণ্টন করতেন এই নূর মুহাম্মদ। এছাড়াও ২০২২ সালের নভেম্বরে গোয়েন্দা সংস্থা ও র‌্যাবের মাদকবিরোধী যৌথ অভিযানের সময় সন্ত্রাসীদের হামলায় গোয়েন্দা সংস্থার একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিহত হন। ওই সন্ত্রাসী হামলায় একজন র‌্যাব সদস্যও গুরুত্বর আহত হন। এই হত্যাকান্ডের সাথে নূর মুহাম্মদ সরাসরি জড়িত ছিল এবং ঘটনাস্থলে নিজে উপস্থিত থেকে উক্ত কর্মকর্তার মৃত্যু নিশ্চিত করেন বলে জানা যায়। বিভিন্ন সময়ে অপহরণ, টার্গেট কিলিং শেষে কক্সবাজারের গহীন পার্বত্য এলাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় আত্মগোপনে থাকতেন নূর মুহাম্মদ। তার বিরুদ্ধে উখিয়া, নাইক্ষ্যংছড়িসহ বিভিন্ন থানায় হত্যা, অপহরণ, অস্ত্রসহ বিভিন্ন অপরাধে ১৫ টির অধিক মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব।

 

র‌্যাব আরো জানায়, গ্রেফতারকৃত মোঃ হোসেন @ জোহার (৩০) জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক। তিনি ২০১৬ সালে আরিফ উদ্দিন @ হাসেমের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আরসা’য় যোগ দেন। আরসা’য় যোগদানের পর তিনি অস্ত্র চালনা, কুংফু ও রণকৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ লাভ করেন। তিনি ২০১৭ সালে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশপূর্বক শরণার্থী ক্যাম্প-১৫ এ অবস্থান করে আসছিলেন। পরবর্তীতে ক্যাম্প-১৫ এ আরসা’র হেড জিম্মাদার হিসেবে দায়িত্ব পান। বিভিন্ন সময়ে হাফেজ নূর মুহাম্মদ ও মাস্টার সলিমের নির্দেশনায় তার নেতৃত্বে টার্গেট কিলিং, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় এবং মুক্তিপণ না পেলে হত্যাপূর্বক লাশ গুম করা হতো। এছাড়াও শরণার্থী শিবিরে হেডমাঝি আবু তালেবকে গুলি করে হত্যা, সাবমাঝি সৈয়দ হোছেনকে গুলি করে চোখ উপড়ে ফেলে হত্যা ও শফিকুর রহমানকে গুলি করে হত্যার প্রধান সহযোগী হিসেবে জড়িত ছিলেন এই জোহার।

 

এছাড়া গ্রেফতারকৃত ফারুক @ হারেস (২৩) জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক। তিনি ২০১৭ সালে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ এবং শরণার্থী হিসেবে শিবিরের ক্যাম্প-১৫ এ অবস্থান করতেন। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে মাস্টার সলিমের সেকেন্ড ইন কমান্ড তার আপন বড়ভাই মোঃ শাহ আলমের মাধ্যমে আরসা’য় যোগ দেন। তিনি ক্যাম্প-১৫ এর আরসা’র প্রহরী দলের প্রধান সমন্বয়কারী এবং ‘টর্চার সেল’ এর তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। তার ৭-৮ জনের একটি ‘নেট গ্রুপ’ রয়েছে যারা নিয়মিত ক্যাম্পের প্রহরীর দায়িত্ব পালন করতেন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নিকট রিপোর্ট প্রদান করতেন। এছাড়াও তিনি নিয়মিত স্থানীয় দোকানপাট হতে মাসিক চাঁদা আদায়সহ বিভিন্ন অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।

 

র‌্যাবের দেওয়া তথ্যমতে, গ্রেফতারকৃত মনির আহাম্মদ, নূর ইসলাম ও ইয়াছিন জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক। তারা ২০১৬ সালে আরসা’র সন্ত্রাসী গ্রুপে যোগদান করেন। আরসা’য় যোগদানের পর তারা মিয়ানমারের অভ্যন্তরে অস্ত্র চালনার উপর প্রশিক্ষণ লাভ করেন। পরবর্তীতে তারা ২০১৭ সালে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ এবং শরণার্থী হিসেবে শরণার্থী শিবিরের ক্যাম্প-১৬ এ অবস্থান করেন। এরা সকলেই মোঃ হোসেন @ জোহারের অধীনস্থ ১০-১২ জনের সন্ত্রাসী দলের সদস্য। বিভিন্ন সময়ে তারা স্থানীয় দোকানপাট হতে মাসিক চাঁদা উত্তোলন, অপহরণপূর্বক মুক্তিপণ আদায়, মুক্তিপণ না পেলে লাশ গুমসহ অন্যান্য অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত ছিলো বলে জানা যায়। এছাড়াও তারা পাহাড়ে অবস্থিত গোপন আরসা ঘাঁটির নিরাপত্তা প্রহরীর দায়িত্ব পালন করতেন বলে জানা যায়।

 

এদিকে আরসার শীর্ষ সন্ত্রাসী হাফেজ নূর মুহাম্মদকে তার ৫ সহযোগীসহ গ্রেপ্তারের পর শনিবার (২২ জুলাই) সকাল সাড়ে ১০টায় এ বিষয়ে র‍্যাবের কক্সবাজার সদর দপ্তরে সাংবাদিকদের ব্রিফ করে অভিযানের বিস্তারিত তুলে ধরেন সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন।

এইচ এম কাদের,সিএএন বাংলা২৪