নুর মোহাম্মদ ও শওকত আলম, কক্সবাজার :
বহুল কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের ট্রেন অবশেষে এসে পৌঁছেছে কক্সবাজারে। এ নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে চলে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। ট্রেন দেখার জন্য হাজারো উৎসুক জনতা ভিড় করে ঝিনুক আকৃতির আইকনিক কক্সবাজার রেলস্টেশনে।সকালে চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনটি সন্ধ্যা নাগাদ কক্সবাজার এসে পৌঁছায়। বিষয়টি নিশ্চিত করে দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের পরিচালক মো. সুবক্তগীন জানান, ট্রেনটি কক্সবাজার রেললাইনের বিভিন্ন অংশ ও নির্মাণাধীন ব্রিজগুলোতে পর্যায়ক্রমে থামে। ট্রেনে থাকা বাংলাদেশ রেলওয়ের ইন্সপেকশন টিম পুরো রেলপথ পর্যবেক্ষণ করেন। আগামী ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করবেন এই রেলপথ।
তিনি আরও বলেন, সকালে ৮টি বগি ও ইঞ্জিন নিয়ে রেলটি চট্টগ্রাম ছেড়ে আসে। সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ ট্রেনটি কক্সবাজারে এসে পৌঁছায়। আগামীকাল সোমবার সেটি আবারও চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবে।জানা গেছে, নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ হলেও নতুন নির্মিতব্য ৯টি স্টেশনের মধ্যে কয়েকটির কাজ এখনও শেষ হয়নি। বাকি আছে কিছু লেভেল ক্রসিংয়ের কাজ। অপরদিকে কক্সবাজার সদরের ঝিলংজা ইউনিয়নের চান্দেরপাড়ায় ঝিনুক আকৃতির আইকনিক স্টেশনের বাকি কাজও এগিয়ে চলেছে দ্রুত গতিতে। ৬তলা ভবনের ২তলা পর্যন্ত এবং যাত্রীদের জন্য ওয়েটিং রুম ও এস্কেলেটরসহ আনুষাঙ্গিক কাজ প্রায় শেষের পথে।
এছাড়া দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনের আওতায় ৩৯টি বড় সেতু, ২২৩টি ছোট সেতু ও কালভার্ট, বিভিন্ন শ্রেণির ৯৬টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। আরো রয়েছে হাতি চলাচলের দুটি আন্ডারপাস। যাত্রীদের সুবিধার্থে নির্মাণ করা হয়েছে ৯টি স্টেশন। স্টেশনগুলো হলো- দোহাজারী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, হারবাং, চকরিয়া, ডুলাহাজরা, ইসলামাবাদ, রামু ও কক্সবাজার।এদিকে সম্ভব্য ট্রেনের সময় নির্ধারণ প্রসঙ্গে জানা গেছে, ট্রেনটি ঢাকা থেকে রাত ৯টা ১০ মিনিটে যাত্রা শুরু করে সকাল সাড়ে ৬টায় কক্সবাজারে পৌঁছাবে। কক্সবাজার থেকে দুপুর ১টায় যাত্রা করে রাত ৯টা ১০ মিনিটে ঢাকায় ফিরবে। ঢাকা থেকে কক্সবাজারের সর্বনিম্ন ভাড়া ৫১৫ টাকা। সর্বোচ্চ এসি বার্থে ভাড়া পড়বে ২,০৩৬ টাকা। চট্টগ্রাম থেকে সর্বনিম্ন ৫৫ থেকে সর্বোচ্চ ৭৭৮ টাকা।
যখন ট্রেন আসবে এই শহরে, কক্সবাজারে ট্রেন আসার স্বপ্ন নিয়ে বহু বছর আগে এই নামে কাব্যগ্রন্থ লিখেছিলেন কক্সবাজারের কবি মনির ইউসুফ। অবশেষে সেই স্বপ্ন বাস্তবতায় রূপ নিয়েছে। অবশেষে কক্সবাজারে এসেছে অগণিত মানুষের স্বপ্নের রেল।রোববার (৫ নভেম্বর) চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইনে পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম চলাচল করে ৮ বগির রেল।চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথের জন্য একাধিক নতুন ট্রেন চালুর সময়সূচি এবং ট্রেনের ছয়টি নাম প্রস্তাব করে পূর্বাঞ্চল মহাব্যবস্থাপকের কার্যালয় থেকে ঢাকা রেল ভবনে পাঠানো হয়েছে। ৭ নভেম্বর রেলমন্ত্রী এসব ট্রেনের সময়সূচি ঘোষণা করবেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এরপর আগামী ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথের উদ্বোধন করবেন। ওই দিন রেললাইনের সময়সূচি ও নামগুলো ঘোষণা করবেন।
তবে রেলের ট্রায়াল রানের পরও কিছু আনুষঙ্গিক কাজ চলবে। তাই যাত্রীবাহী রেল চলাচল করতে আরও দুই মাস সময় লাগতে পারে।ট্রেনে কক্সবাজার থেকে ঢাকা যেতে সময় লাগবে ৯ ঘণ্টা, আর চট্টগ্রাম থেকে সোয়া দুই ঘণ্টায় ট্রেন পৌঁছাবে কক্সবাজারে।কক্সবাজারে আসা ট্রেনটিতে রয়েছেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের জেনারেল ম্যানেজার ও রেলের পরিদর্শন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তারা কক্সবাজারে অবস্থান করে ৬ নভেম্বর রেলস্টেশন ইয়ার্ড পরিদর্শন এবং ৭ নভেম্বর সকাল ৭টায় চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওয়ানা দেওয়ার কথা রয়েছে।সরকারি রেল পরিদর্শক (জিআইবিআর) শাখা সূত্র জানায়, ট্রেনযোগে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারে পৌঁছান রেল পরিদর্শন দপ্তরের টিম। এসময় নির্মাণাধীন দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন ও বিভিন্ন স্টেশন পরিদর্শন করা হয়েছে। পথে কোথাও কোনো ত্রুটি আছে কি না তা যাচাই করে দেখা যায়।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের জেনারেল ম্যানেজার নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘এটি আমাদের রুটিন কাজ। এটিকে ট্রায়াল রান বলা যাবে না। আমাদের সঙ্গে রেল পরিদর্শন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ছিলেন। তারা রেলপথ পরিদর্শন এবং ইন্টারলকিং সিগন্যালিং ব্যবস্থা, প্ল্যাটফর্ম উঁচু সঠিক কি না, কালভার্ট, লেভেল ক্রসিং গেট দেখেন। ফিরে গিয়ে পরিদর্শন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা সার্টিফাই করবেন। এরপর ট্রেন চলবে।’দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের পরিচালক সুবক্তগীন বলেন, ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজারে আসবেন। তিন ট্রেন চলাচল উদ্বোধনের পর বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলবে নভেম্বরের শেষ বা ডিসেম্বরের শুরু থেকে। কক্সবাজার রুটে ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে ছয় জোড়া ট্রেন চলাচলের পরিকল্পনা আছে। তবে ইঞ্জিন ও বগি সংকটের কারণে এখনই তা হচ্ছে না। পর্যায়ক্রমে বাড়ানো হবে।
কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশন ও রেলপথ নির্মাণে দায়িত্বে রয়েছেন প্রকৌশলী এনামুল হক সরকার এনাম। তিনি বলেন, আমার অবকাঠামোগত কাজ সমাপ্ত বলা যায়। এখন ফিনিশিংয়ের কাজ চলছে। আমরা ৯০ শতাংশ কাজ শেষ করতে পেরেছি। বাকি কাজ প্রকল্পের মেয়াদ শেষের আগেই সমাপ্ত হবে বলে আশাবাদী আমরা।দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প ২০১০ সালের ৬ জুলাই একনেকে অনুমোদন পায়। ২০১৮ সালে রেলপথ নির্মাণ কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সালের ৩০ জুন। পরে এক দফা বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ করা হয় ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। এতে ব্যয় ধরা হয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।প্রকল্পে ঋণ সহায়তা দিচ্ছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। তবে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়লেও ব্যয় বাড়েনি। এ প্রকল্পের কাজ পুরোদমে চলায় নির্ধারিত সময়ের আগেই তা শেষ হতে যাচ্ছে।