ই-পেপার | শুক্রবার , ৩রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

রোহিঙ্গা শিবিরে সহিংসতা নিরসনে পদক্ষেপ জরুরি

মো. আরিফ উল্লাহ :

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধ প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। একের পর এক হত্যাকাণ্ড, মাদক, মানবপাচার, অগ্নিকাণ্ড, অস্ত্র ও চোরাচালান এবং অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবীর ঘটনা ঘটছে। শিবিরের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সরকার প্রতি বছর রোহিঙ্গা শিবিরের বিভিন্ন খাতে শত শত কোটি টাকা খরচ করছে। কিন্তু সরকারের এই কন্ট্রিবিউশন যতোটা প্রশংসার দাবী রাখে তা তো পাচ্ছেই না বরং রোহিঙ্গা শিবিরের কিছু কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে। চলমান অপরাধ কর্মকাণ্ডের ফলে ঝুঁকিতে রয়েছে ক্যাম্পের ভেতরে অবস্থিত স্থানীয় বাসিন্দা, ২০ হাজারের বেশী এনজিও কর্মী এবং অসহায় রোহিঙ্গারা। এই অপরাধ রোহিঙ্গা শিবির থেকে ছড়িয়ে পড়েছে সমগ্র কক্সবাজার জেলায়। বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডে রোহিঙ্গাদের সম্পৃক্ততার খবর প্রায়ই পত্র পত্রিকার শিরোনামে উঠে আসে। অতীতের তুলনায় উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলাসহ সমগ্র জেলাজুড়ে অপহরণ, চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। রোহিঙ্গা শিবিরের ভিতরে পরিস্থিতি আরো নাজুক। এই পরিস্থিতি তৈরির পেছনের কারণ হিসেবে যে সকল বিষয় মূখ্য ভূমিকা পালন করছে তা হলো রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থিত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর উপস্থিতি জানান দেয়া, আধিপত্য বিস্তার করা, নিরবচ্ছিন্ন মাদকের কারবার পরিচালনাসহ অর্থনৈতিকভাবে সংগঠনকে শক্তিশালী করা ইত্যাদি।

 

রোহিঙ্গা শিবিরে অন্তত ১০ থেকে ১২ টি সশস্ত্র দল সক্রিয় রয়েছে যেখানে ৩ সন্ত্রাসী সংগঠন ও বাকী সব ডাকাতদল। এদের অস্তিত্ব দেখা দেয় মূলত সন্ধ্যার পর থেকে সকাল ৯ টার মধ্যবর্তী সময়ে।

 

গতবছর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২১ সালে ২২ টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, যেখানে ২০২২ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৩২ এবং কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্য অনুসারে আগস্ট ২০২৩ পর্যন্ত রোহিঙ্গা শিবিরে খুনের ঘটনা ঘটে ৫৩টি। এই ৫৩ জনের অধিকাংশই ক্যাম্পের হেড মাঝি, ব্লক মাঝি বা ক্যাম্প ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত ছিলো। মূলত যে সকল মাঝী সন্ত্রাসী বাহিনীর কথা মেনে নিতে অস্বীকার করে, যারা সাধারণ রোহিঙ্গাদের দাবীর পক্ষে কথা বলে এবং ক্যাম্প ব্যবস্থাপনায় জড়িত কোনো দপ্তরের পক্ষে কথা বলে বা কাজ করে সে সকল রোহিঙ্গা এই সন্ত্রাসী দলগুলোর টার্গেটে পরিণত হয়। এছাড়াও যারা ক্যাম্পের নিরাপত্তা নিশ্চিতে নিয়োজিত আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হয়ে কাজ করতে চায় তারাও তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়না। এই অবস্থায় কোনো রোহিঙ্গা তার সাথে ঘটে যাওয়া কোনো বিষয় মুখে আনতে পারেনা, কেউ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে সাহস দেখায় না।

 

রোহিঙ্গা পরিবারগুলোর মধ্যে এখন এই বিষয়টি পরিষ্কার যে শিবিরে পান থেকে চুন খসলেই তাদের রাত দীর্ঘ হয়ে যাবে, অথবা তার বাড়ি আগুনে পুড়ে যাবে, নাহয় তাকে ক্যাম্প পরিত্যাগ করতে হবে। অন্যথায় হারাতে হবে নিজের জীবন বা পরিবারের কোনো সদস্যের জীবন। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয়টি হলো রোহিঙ্গা যুবকরা এই সন্ত্রাসী গ্রুপের সাথে জড়িয়ে পড়ছে এবং এই প্রবণতা অনেক বেশী। একে তো অলস মস্তিষ্ক তার উপর ক্যাম্পে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য অন্যতম একটি ক্ষেত্র এই সন্ত্রাসী দলগুলো। প্রতিটি যুবক চায় নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন করতে, নিজেকে জাহির করতে ও নিজের প্রশংসা শুনতে। কিন্তু আগামীর কক্সবাজারসহ সমগ্র বাংলাদেশের জন্য এটি কতো বড় হুমকি হয়ে দাড়াবে তা কল্পনা থেকেও বহুদূরে।

 

উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার ক্যাম্প সন্নিহিত গ্রামগুলোতে সাধারণ মানুষ চলাচল করতে ভয় পায়। ২০২৩ সালে উভয় উপজেলা থেকে অন্তত ৫০ জনের বেশী মানুষ অপহরণের শিকার হয়েছে, এই তালিকা থেকে বাদ যায়নি শিশু থেকে বৃদ্ধ, কৃষক থেকে রাজনীতিবিদ কেউ। মুক্তিপণ দিতে দেরি করলে কিংবা না দিলে অপহৃত ব্যক্তিকে জীবিত পাওয়া যায়না। এই অপহরণে ঘটনার সাথে স্থানীয় ডাকাত ও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী উভয়ই জড়িত আছে।

 

রোহিঙ্গা শিবিরের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হলে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধিসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের পরামর্শক্রমে এই বাহিনীকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। কাঁটাতারের বেষ্টনীর মেরামত করে অবৈধ চলাচল বন্ধ করা। ক্যাম্পের ওয়াচ টাওয়ার ও সিসিটিভি ক্যামেরার মনিটরিং বৃদ্ধি করতে হবে। ক্যাম্প ত্যাগের ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের উল্লেখিত কারণ বিবেচনায় ক্যাম্প ইন চার্জ এবং এপিবিএনকে আরো কঠোর হতে হবে। ক্যাম্পের বাহিরে পুলিশ ও বিজিবির চেকপোস্টগুলোকে এই বিষয়ে আরো বেশী তৎপর হতে হবে। ইউএন এজেন্সিগুলো এ ব্যাপারে সরকারকে লজিস্টিক ও টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিতে পারে, এছাড়াও মসজিদ ভিত্তিক সচেতনেতা তৈরি করা। রোহিঙ্গা যুবকদের মাঝে দেশপ্রেম ও নিজের জাতির জন্য সহানুভূতি জাগানো এবং তাদের অলস সময় যেন বিভিন্ন কাজে লাগানো যায় এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় রোহিঙ্গা শিবিরের পাশাপাশি স্থানীয় জনগোষ্ঠী অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হবে, যা আমাদের কারো কাম্য নয়।

 

লেখকঃমোঃ আরিফ উল্লাহ,

উন্নয়ন কর্মী, কোস্ট ফাউন্ডেশন, কক্সবাজার।
Email:[email protected]