বিশেষ প্রতিবেদক :
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিদায়ী (২০২৩) বছরে উত্তপ্ত ছিল রাজনৈতিক অঙ্গন। রাজনীতির সেই হাওয়ায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে আদালতে।
বছর জুড়ে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার নিয়ে উত্তাপ ছড়িয়েছে।এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তার স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানকে সাজা দেওয়া হয় এ বছরই। নাইকো শুরু হয় মামলায় খালেদা জিয়ার বিচার।
বছরের শেষ দিকে এসে গত পনের বছরে নাশকতার অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলায় সহস্রাধিক বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে আসে কারাদণ্ডের রায়। দণ্ডিতের তালিকায় দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা, সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতারাও রয়েছেন। আদালত থেকে রিমান্ড ও সাজার ঘটনায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দলটি অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়ে। বিরোধী নেতাকর্মীদের উল্লেখযোগ্য সাজা ও দণ্ড নিয়ে সালতামামির এই আয়োজন।
নাইকো মামলায় নিষ্পত্তিতে গতি: বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুই মামলায় ইতোমধ্যে দণ্ডিত হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে এখনও অনেক মামলা বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন। ঢাকার আদালতে বিচারাধীন নাইকো দুর্নীতি মামলা নিষ্পত্তিতে বেশ তোড়জোড় দেখা গেছে। গত ১৯ মার্চ নাইকো দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৯ এর বিচারক শেখ হাফিজুর রহমান। এরপর দ্রুততার সঙ্গে মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। নাইকো মামলায় রয়েল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশের দুই সদস্য ও এফবিআই’র কর্মকর্তাও কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থাপিত অস্থায়ী আদালতে সাক্ষ্য দেন।
তবে খালেদা জিয়ার নামে চলমান গ্যাটকো দুর্নীতি মামলা, বড়পুকুরিয়া মামলা খনি দুর্নীতি মামলাসহ নাশকতার অন্য মামলার বিচার খুব একটা এগোয়নি।
তারেক জোবাইদার কারাদণ্ড: ইতোপূর্বে চার মামলায় কারাদণ্ড হয় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের। তবে তার স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে এ বছরই প্রথম কোনো সাজার রায় ঘোষণা হয় আদালত থেকে। দুদকের করা জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের মামলায় গত ২ আগস্ট বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ৯ বছর ও তার স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেন ঢাকার মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ মো.আছাদুজ্জামান।
রায়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইন ২০০৪ এর ২৬ (২) ধারায় তারেক রহমানকে তিন বছর ও ২৭(১) ধারায় ছয় বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়া তাকে তিন কোটি টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাস কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে জোবাইদা রহমানকে ২৭(১) ধারায় তিন বছর কারাদণ্ড দেন আদালত। এছাড়া তাকে জরিমানা ৩৫ লাখ টাকা জরিমানা,অনাদায়ে এক মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়া তারেকের দুই কোটি ৭৪ লাখ ৯৩ হাজার ৮৭ টাকা রাষ্ট্রীয় অনুকূলে বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হয়।
২০০৮ সালে তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এরপরই মামলা বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন জোবাইদা। ওই বছরই এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। এর বিরুদ্ধে আপিল করলে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের আদেশ বহাল রাখেন। গত বছর এ মামলার স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে রুল খারিজ করেন হাইকোর্ট।
এরপর গত ১৩ এপ্রিল এই মামলায় তাদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। এরপর ২১ মে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। বিচার শুরুর আড়াই মাসের মধ্যেই তাদের সাজার রায় দেওয়া হয়। এই মামলার বিচারকে ঘিরে বিএনপি ও আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবীদের মধ্যে কয়েক দফা সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে।
বিএনপিতে গ্রেপ্তার আতঙ্কের মধ্যেই সাজার খড়্গ: গত বছর ১০ ডিসেম্বর কর্মসূচিকে ঘিরে সংঘর্ষ ও গ্রেপ্তার আতঙ্ক কাটিয়ে চলতি বছর ফের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন ইস্যুতে একদফার আন্দোলন শুরু করে বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো। তাদের ডাকে গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। নয়াপল্টনে বিএনপির সেই সমাবেশকে ঘিরে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনায় এক পুলিশ সদস্যের মৃত্যু হয়। এরপর সারা দেশে দলটির ২১ হাজার ৮৩৫ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে দাবি করেছে বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের সংগঠন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম। যার মধ্যে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ শীর্ষ অনেক নেতা রয়েছেন। গ্রেপ্তারের পর এসব নেতাকর্মীর আদালতে হাজির করাকে ঘিরে পুরান ঢাকার আদালত পাড়ায় ছিল রাজনীতির উত্তাপ।
গত দুই মাসে বিএনপির সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে নাশকতার মামলায় সাজা দেওয়া হয়েছে। গত ১৮ ডিসেম্বর জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ও বিএনপির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল জানিয়েছেন, বিগত দুই সপ্তাহে ৭৯ মামলায় এক হাজার ২৩৯ জনকে সাজা দেওয়া হয়েছে। এর পরবর্তী তিন কার্যদিবসে আরও অন্তত: ১৭৯ বিএনপি নেতাকর্মীকে সাজা দেওয়া হয় ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে।
এসব রায়ে সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব, ভাইস চেয়ারম্যান ও নোয়াখালী-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলহাজ মো. শাজাহান, কুষ্টিয়া-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আহসান হাবিব লিংকন, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক মীর সরপত আলী সপু, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নীরব, যুবদলের বর্তমান সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, স্বেচ্ছাসেবক দলের সেক্রেটারি রাজিব আহসান, ছাত্রদলের সাবেক সেক্রেটারি আকরামুল হাসান মিন্টু, হাবিবুর রশিদ হাবিব, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্য সচিব রফিকুল ইসলাম মজনু প্রমুখ। এর মধ্যে সোহেল, টুকু, নীরবসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে একাধিক মামলায় কারাদণ্ড হয়েছে।
ফখরুলের জামিন শুনানির দিনে ককটেল বিস্ফোরণ: রাজনৈতিক উত্তাপের মধ্যে গত ২০ নভেম্বর বিকেল ৪টার দিকে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিকট শব্দে একটি ককটেল বিস্ফোরণ হয়। যার কিছু সময় আগেই একই আদালতে প্রধান বিচারপতির বাসায় হামলার ঘটনায় রমনা থানার মামলায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মামলার জামিন শুনানি ছিল। শুনানিকে ঘিরে দুই বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা আদালতে হট্টগোলও করেন। যদিও সেদিন আর জামিন শুনানি হয়নি।