ই-পেপার | বুধবার , ৩রা জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

৭০ বছর ধরে ধাত্রীসেবায় লালমন বিবি

জেলা প্রতিনিধি, মাদারীপুর

লালমন বিবি। বয়স ৮৫ বছর। প্রসবের খবর এলে ছুটে চলেন নদীর এপার থেকে ওপারে। দিয়ে থাকেন ধাত্রীসেবা। আর সেই সেবাই এখন তার নেশা। বলছি মাদারীপুর সদর উপজেলা ঝাউদি ইউনিয়নের হোগলপাতিয়া গ্রামের মৃত্যু আবদুল মালেক হাওলাদারের স্ত্রী লালমন বিবির কথা।মাত্র ১৫ বছর বয়সেই ২৫ বছরের যুবক আবদুল মালেক হাওলাদারের সঙ্গে বিয়ে হয় লালমন বিবির। এদিকে হাতের মেহেদি রং শেষ হতে না হতেই তিন দিনের মাথায় যেতে হয়েছে মাদ্রা এলাকায় সালেহা বেগমের বাচ্চা প্রসব বা ধাত্রী কাজে। ছিল না তার প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান। ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বর মাসের দিকে মাদারীপুর টিবি ক্লিনিকের চিকিৎসকরা একদিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে শিখিয়েছিলেন কীভাবে বাচ্চা ডেলিভারি করতে হয়। আর সেই একদিনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ৭৫ বছর ধরে চলছে তার এই ধাত্রী সেবার কাজ। এ পর্যন্ত ৮-১০ হাজারের বেশি মাকে এ সেবা দিয়েছেন লালমন বিবি।

লালমন বিবির দুই ছেলে ও তিন মেয়ে। বড় ছেলে লাল মিয়া হাওলাদার জন্মের কয়েক বছর পরেই মারা যান। এখন তার এক ছেলে চানমিয়া হাওলাদার ও তিন মেয়ে নেহার বেগম, রিনা বেগম, ফাতেমা খানম এ নিয়ে তার সংসার। তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন তিনি।সরেজমিনে গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৩৮ সালে হাওলাদার পরিবারে লালমন বিবির জন্ম হয়। বাবা দাদায় মৌলভি (আলেম) থাকায় তাদের কাছ থেকে পেয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষা। আয়ত্ত করেছেন কোরআন। বেড়ে ওঠার ১৫ বছর বয়সে বিয়ে হয় আব্দুল হাওলাদারের সঙ্গে।

 

তিনি ছোটবেলায় থেকেই ছিলেন পরোপকারী। যেখানে মানুষের বিপদের কথা শুনতেন সেখানেই ছুটে চলতেন তিনি। আর সেই উপকারের দিক ধরে রেখে চলছেন ১৫ বছর পর থেকে ধাত্রী কাজ করে। তিনি ধাত্রী কাজের পাশাপাশি কোনো নারী মারা গেলে করান গোসল। বিনা পারিশ্রমিকে নিজের অর্থ ব্যয় করে ছুটে চলেন নদীর এপার থেকে ওপারে এবং ইউনিয়ন থেকে আরেক ইউনিয়নে। এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে। তিনি নারীদের কোনো সমস্যার কথা শুনলে ছুটে চলেন সেখানে। স্থানীয়রা তাকে বড় কদর করে ডেকে নেন। দীর্ঘ ৭০ বছর ধাত্রীর কাজ এবং নারীদের গোসল করিয়ে পড়তে হয়নি কোনো সমস্যায়। এদিকে তার কাছ থেকে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকর্মীরা নেন পরামর্শ। মানব সেবায় নিয়োজিত থাকা ধাত্রী লালমনি বিবি বলেন, আমার বিয়ের পর থেকেই আমি নারীদের ডেলিভারির (ধাত্রী) ও গোসল করানোর কাজ করে আসছি। আল্লাহর রহমতে আজ পর্যন্ত আমি কোনো বিপদের মুখে পড়িনি। আমার এমনও দিন গেছে ধাত্রীর কাজ করতে এলাকা থেকে অন্য এলাকায় গিয়ে তিনদিন পর্যন্ত থাকতে হয়েছে। ছেলে মেয়েরা অনেক সময় না খেয়ে থেকেছে। আমার এমন একটা সময় ছিল দিনরাত মিলে ৫-৬টি ডেলিভারির কাজ করতে হয়েছে। আমি এলাকার একাই কাজ করেছি। আমার কাজের অনেক চাপ ছিল। এটা এখন এক ধরনের একটা নেশা হয়ে গেছে মানুষের উপকার না করতে পারলে ভালো লাগে না।

 

আমি নিজের টাকা ব্যয় করে মানুষের সেবা করেছি। আমি তাদের কাছ থেকে কোনো সময় কোনো আর্থিক সহযোগিতা পাইনি বা চাইনি। এটা আমার বিবেকে কখনো সাঁই দেইনি। এ পর্যন্ত আমি ৮ থেকে ১০ হাজার ধাত্রীর কাজ করেছি। অনেক মৃত নারীদের আমি গোসল করিয়েছি। আমি যাদের ধাত্রী সেবা দিয়েছি আজ তারা বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কেউ আজ পর্যন্ত আমার কোনো খোঁজখবর নেয়নি। আমি চাই সরকার যেন ধাত্রীদের একটা মূল্যায়ন করে।পশ্চিম মাদ্রা এলাকার বিলকিস বেগম বলেন, ‘আমার প্রসব ব্যথা উঠলে পরিবারের লোকজন লালমন বিবিকে ডেকে নিয়ে আসেন। বিনা অপারেশনে তার হাতেই আমার প্রথম সন্তান হয়।’

 

রাজারচর গ্রামের সেফালী বেগম সিএনএন বাংলা২৪কে বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। আমার স্বামী কৃষি কাজ করে। তাই ডাক্তারের কাছে যাওয়ার টাকা আমার কাছে ছিল না। আমাদের কাছে গরিবের ডাক্তার লালমন বিবি। তার সহযোগিতায় আমি মা হয়েছি তিনি সব সময় পাশে থাকেন।ঝাউদি ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. লোকমান বেপারী বলেন, আমি জন্মের পর থেকে দেখেছি চাচি ধাত্রীর কাজ করে চলছেন। তাকে কেহ ডাক দিলেই তিনি ছুটে চলেন তার কাছে। কে শত্রু কে বন্ধু এ চিন্তা তিনি কখনোই করেননি। তিনি আগে মানুষকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে চেয়েছেন। তার মতো মানুষ সমাজে খুবই কম।

 

এ বিষয়ে মাদারীপুর মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত) মাহমুদা আক্তার কণা সিএনএন বাংলা২৪কে বলেন, হোগলপাতিয়া গ্রামে লালমনবিবি দীর্ঘদিন ধরে ধাত্রী সেবা দিয়ে আসছেন। ধাত্রী সেবায় তিনি অনেক দক্ষ। গ্রামের মেয়েরাও তার কাছে আসেন এ সেবা নিতে। জেলাজুড়ে এ কাজের জন্য তার অনেক সুনামও আছে।