মোঃ আবদুর রহিম জয় চৌধুরী :
লালদিঘি আমাদের চিরচেনা নগর চট্টগ্রামের একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান। এটি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৩২ নং ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত জেল রোডের শেষ প্রান্তে অবস্থিত। এর চারপাশে রয়েছে আন্দরকিল্লা, জেলা পরিষদ ভবন এবং স্থানীয় কিছু ব্যাংকের শাখা।
১৭৬১ সালে চট্টগ্রামের শাসনভার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উপর অর্পিত হওয়ার পর জমি সংক্রান্ত তহসিল অফিসকে লাল রং করা হয়েছিল। সে সময় এটি “লালকুটি” হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠে। পরবর্তিতে এর পূর্ব দিকে অবস্থিত জেলখানাকেও লাল রং করা হয়েছিল এবং এটিকে “লালঘর” নামে অবহিত করা হয়। লালঘর আর লালকুটির পাশে থাকায় দিঘিটি পরবর্তীতে লালদিঘি নামে পরিচিতি পায়।
ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে রাস্তা নির্মাণের ফলে দুই ভাগে বিভক্ত মিউনিসিপাল ময়দানের একপাশে ছিল সাধারণ জনগণের খেলার মাঠ এবং অন্যপাশে ছিল মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ। এই মাঠটিই বর্তমানে ঐতিহাসিক লালদিঘির মাঠ নামে পরিচিত।
বর্তমানে লালদিঘির পশ্চিম পাশে একটি মসজিদ ও একটি পার্ক রয়েছে। মনোরম পরিবেশে ঘেরা এই দিঘির পার্কে প্রতিদিন বহু মানুষ আসে ভ্রমণ করতে ও সময় কাটাতে।
লালদিঘির মালিকানা :
লালদিঘির উত্তর পাশে রয়েছে একটা মঠ, যার গম্বুজে লেখা আছে ১৯৩৯ সাল। এটার গায়ে লেখা আছে রায় বাহাদুর রাজকমল ঘোষের নাম। রায় বাহাদুর ছিলেন একজন জমিদার। তাঁর নিজ বাড়ি ছিল চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার চিকদাইর গ্রামে। তিনি অবসর সময় কাটাতেন তখনকার খোলামেলা লালদিঘির পাড়ে। তিনি ছিলেন লালদিঘির অভিভাবক। পরবর্তিতে তিনি দিঘিটির মালিকানা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের হাতে তুলে দেন।
রিকেট ঘাট :
লালদিঘির পশ্চিম পাড়ে ছিলো “রিকেট ঘাট”। ১৯৪১ হতে ১৯৪৮ পর্যন্ত চট্টগ্রামের কমিশনার হিসাবে দায়িত্ব পালন করা স্যার হেনরি রিকেটস এর স্মরণে চট্টগ্রামের জমিদারেরা এই ঘাট নির্মাণ করেছিলেন। মিঃ হার্ভে ১৮৩১-১৮৩৯ সালে চট্টগ্রামের কালেক্টর ছিলেন। তিনি ৩২ ডেপুটি কালেক্টর ও কয়েকজন জরিপ আমিন নিয়ে জরিপের কাজ শুরু করেন। জরিপে তিনি ২০ গন্ডার স্থলে ১৮ গন্ডায় কানি হিসাব করেন। এ কারণে তাঁর উপর সবাই এত অসন্তুষ্ট হয়েছিল যে চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানায় লোকজন তাকে আক্রমণ করে। তিনি তারপর সৈন্যদের গুলি করার নির্দেশ দেন। এই খবর পেয়ে কর্তৃপক্ষ মিঃ রিকেটকে প্রেরণ করে। ১২০০ মঘীর জরিপের সময় চট্টগ্রামবাসীর উপকার করে তিনি সকলের শ্রদ্ধাভাজন হয়েছিলেন। ঊনবিংশ শতকে চট্টগ্রামের সেশন জজ টোডেল সাহেবের মৃত্যুর পর তাঁর শবদেহ রিকেট ঘাটের উত্তর দিকে দাহ করা হয়। তাঁর স্মৃতিতে নির্মাণ করা স্তম্ভটি পরবর্তীকালে ভেঙ্গে ফেলা হয়।
লালদিঘির ময়দান :
মেট্রোপলিটন পুলিশ সদর দপ্তরের পাহাড়ের পাদদেশ থেকে পশ্চিমে পরীর পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্ত পুরো জায়গাটা সেকালে মিউনিসিপাল ময়দান নামে পরিচিত ছিল। ১৮৮৭ সালে এই ময়দানে মহারানী ভিক্টোরিয়ার মূর্তি স্থাপন করা হয়। চল্লিশের দশকে স্বাধীনতা আন্দোলনের যুগে এই মূর্তি অপসারণ করা হয়। ঊনবিংশ শতকের শেষে উত্তর-দক্ষিণ রাস্তাটি হবার পর মিউনিসিপাল ময়দান দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। পূর্ব দিক সাধারণ জনগণের খেলার মাঠে রূপান্তরিত হয়। মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে তখন সে মাঠ মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে পরিনত হয়। এই মাঠ এখন লালদিঘির মাঠ নামে পরিচিতি লাভ করেছে।
লালদিঘির কিংবদন্তি :
লালদিঘির ঘটনা নিয়ে চট্টগ্রামের মানুষের মুখে একটা কিংবদন্তি প্রবাদ প্রচলিত আছে। একবার এক দিনমজুরের মেয়ে ওই দিঘিতে গোছল করতে নেমেছিলো। হঠাৎ পায়ে শিকল বেঁধে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো জলের নিচে একটা দেশে। আসলে ওইটা ছিলো এক বাদশার দরবার। সেই বাদশার বিয়ে ঠিক হয়েছিল লাল বেগমের সাথে। একদিন বাদশা লাল বেগমকে দেখতে চাইলেন, কিন্তু খবর পাওয়া গেলো লাল বেগম তার মুল্লুক থেকে এক ক্রীতদাসের সাথে পালিয়েছে। এ খবর বাদশা তখন জানতেন না। তাই মজুরের ওই মেয়েকে নিয়ে আসা হয়েছে বাদশার সাথে লাল বেগমের অভিনয় করার জন্য। অনেক কথা প্রসঙ্গে বাদশা মেয়েটার আসল পরিচয় জেনে যাযন। ক্ষুব্ধ বাদশার নির্দেশে সবাই আসল লাল বেগমকে খুঁজতে লেগে গেলো। তখন জানা গেলো সে অন্দরকিল্লার দিঘি থেকে দু’শ হাত দূরে পর্তুগীজদের কিল্লায় আছে। বাদশা ওই কিল্লায় আক্রমণ করেন। অনেক অনেক খুনে লাল হয়ে গেলো দিঘির পানি। বাদশা পরাজিত হলেন সেই যুদ্ধে। সবাই পালিয়ে গেল। তবুও সে দিঘির পাড়ে বাদশা থেকে গেলেন লাল বেগমকে উদ্ধার করার আশা নিয়ে। এই নিয়ে একজন চারণ কবি লিখেছেনঃ “লালদিঘিতে আগুন ধরে/জল শুকিয়ে গিয়েছে,/মাছগুলো সব ডাঙ্গায় উঠে/কিলবিল করতে লেগেছে“।
অনুষ্ঠান :
লালদিঘির পাড়ে ১৯১০ সালে বৈশাখের ১২ তারিখ আবদুল জব্বার সর্বপ্রথম বলীখেলা অনুষ্ঠান করেন। তখন থেকে প্রতি বছর বৈশাখের ১২ তারিখ লালদিঘির পাড়ে জব্বারের বলীখেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।বর্তমানে লালদিঘির পশ্চিম পাড়ে একটি মসজিদ আছে। শহরবাসীর চিত্তবিনোদনের জন্য এখানে একটি সবুজ গাছপালা ঘেরা পার্ক আছে।