ই-পেপার | রবিবার , ২৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

জাল কাগজে রাষ্ট্রের ২০০ কোটি টাকা লুট

বাংলা ট্রিবিউন:

পদ্মা সেতুর বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য সরকার ব্যক্তিমালিকানার জমি অধিগ্রহণ করেছে। ক্ষতিপূরণ হিসেবে জমির মালিকদের সরকার টাকা পরিশোধ করেছে। কিন্তু সেই টাকা প্রকৃত মালিকের হাতে না গিয়ে চলে গেছে একশ্রেণির দালালের পকেটে। এ ছাড়া খাস জমিকেও বিভিন্ন ব্যক্তির নামে জাল কাগজ বানিয়ে প্রায় ২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে চক্রটি। চক্রের প্রধান অভিযুক্ত হলেন কে এম নাসির নামে এক ব্যক্তি।

 

মাদারীপুরের শিবচর উপজেলায় ১০ থেকে ১৫টি মৌজার জমি পদ্মা সেতুর বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছে। সেসব জমির ক্ষতিপূরণের বিল নামে-বেনামে তৈরি করে ওই দালাল চক্র। আর সরকারি জমির জাল কাগজপত্র তৈরি করে ব্যক্তিমালিকানা জমি দেখানো হয়েছে। দালাল চক্রের সদস্যদের সহায়তা করেছে জেলা প্রশাসন অফিসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী।

 

ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে জেলা প্রশাসন। মাদারীপুর জেলা প্রশাসকের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার এমন ঘটনার সঙ্গে জড়িত ২০ জনের তালিকা করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) চিঠি দিয়েছে প্রশাসন। সেই তালিকায় এক নম্বরে রয়েছে কে এম নাসিরের নাম। সে শিবচর উপজেলার দত্তপাড়া ইউনিয়নের গুপ্তেরচর এলাকার গবাদিপশু চিকিৎসক কাজী মোজাম্মেল হকের ছেলে।

 

স্থানীয়রা জানান, কে এম নাসির ১০ বছর আগে ঢাকার একটি চায়নিজ রেস্টুরেন্টের ওয়েটার ছিল। এরপর গ্রামে এসে বাবা কাজী মোজাম্মেল হককে পশুর চিকিৎসায় সহায়তা করতো। গত ছয়-সাত বছরের মধ্যে সে এখন কোটি কোটি টাকার মালিক।

 

তারা আরও জানান, পদ্মা সেতুর বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ শুরু হলে কে এম নাসির দালালি শুরু করে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তায় অন্যের জমির অধিগ্রহণ করা, বিল ছাড়িয়ে আনা, অবকাঠামোর ক্ষতিপূরণের বিল কয়েকগুণ বাড়িয়ে আনাসহ বিভিন্নভাবে দালালি শুরু করে সে। একপর্যায়ে মাদারীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার। সেই সুবাদে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যায় এই যুবক।

 

এরপর আর পিছু ফিরতে হয়নি নাসিরকে। গড়ে তোলে বড় একটি দালাল সিন্ডিকেট। অন্যের জমির বিল তুলে আনাসহ সরকারি খাসজমি বিভিন্ন মানুষের নামে ভুয়া কাগজ তৈরি করে কোটি কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে উত্তোলন করতে থাকে। এরপর ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা, সার্ভেয়ারসহ সিন্ডিকেটের সদস্যরা টাকা ভাগাভাগি করে নিতো।

 

চক্রের কবলে পড়ে ক্ষতিপূরণের বিল না পাওয়াদের মধ্যে একজন শিবচরের হারুন বেপারী। তিনি বলেন, ‘ডাইয়ারচর মৌজায় রেল-সংযোগ সড়কে আমার কিছু জমি অধিগ্রহণ করেছে সরকার। সেখানে ৩ কোটি ৬৯ লাখ টাকা বিল হয় আমার। কয়েক বছর ধরে মাদারীপুর এলএ শাখায় বিলের জন্য ঘুরতে ঘুরতে আমি যখন ক্লান্ত, তখন শুনি সেই টাকা নাসিরের দালাল চক্রের সদস্য শাহিন বেপারী ওরফে সাহেব বেপারীর নামে ভুয়া কাগজ তৈরি করে তুলে নিয়ে গেছে।’

 

আরেক ভুক্তভোগী খোকন শিকদার বলেন, ‘মাদবরেরচর ইউনিয়নের ডাইয়ারচর মৌজায় আমার ৬৪২ নম্বর দাগে জমি অধিগ্রহণ হলে প্রায় ৬ কোটি টাকা বিল হয়। সেখান থেকে ২ কোটি ৫২ লাখ টাকা দালাল চক্র তুলে নিয়ে গেছে। এর সঙ্গে সার্ভেয়ার নাসির, ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা প্রমথ রঞ্জন ঘটক, দত্তপাড়ার কে এম নাসির জড়িত আছে।’

 

খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, দালাল চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন ব্যক্তিকে অর্থের লোভ দেখিয়ে তাদের নামে ভুয়া কাগজ তৈরি করে সরকারি অর্থ হাতিয়ে নিতো। যাদের নামে চেক ইস্যু করা হয়েছে, তাদের অ্যাকাউন্টে জালিয়াতি করে নেওয়া সরকারি টাকা জমা হওয়ার পর সেই টাকা চলে যেতো মূল দালাল কে এম নাসিরের অ্যাকাউন্টে।

 

ব্যাংকিং লেনদেনের প্রমাণপত্র আসে এই প্রতিবেদকের হাতে। সেখানে দেখা যায়, ২০২১ সালের ৪ মার্চ এলএ কেস ৫/১৯-২০ এর ১৫৮২৩৯ ক্রমিকে ১ কোটি ৮৮ লাখ ১৪ হাজার ৩০০ টাকার চেক গ্রহণ করেন শাহিন বেপারী ওরফে সাহেব বেপারী। সেই টাকা তার ব্র্যাক ব্যাংকের ৩৫০২১০৪৬৬৩৪০৮০০১ হিসাব নম্বর মাদারীপুর শাখা থেকে ২৫ মার্চ ব্র্যাক ব্যাংক মাদারীপুর শাখার ৩৫০১১০৪২৩৪৭৯২০০১ হিসাব নম্বরে প্রথমবার ৭৪ লাখ টাকা, দ্বিতীয়বার ৭৪ লাখ ১২ হাজার টাকা মোট ১ কোটি ৪৮ লাখ ১২ হাজার টাকা স্থানান্তর করা হয়। ব্র্যাক ব্যাংকের মাদারীপুর শাখার ৩৫০১১০৪২৩৪৭৯২০০১ হিসাব নম্বর কে এম নাসিরের।

 

অনুসন্ধানে উঠে আসে, শিবচর উপজেলার ডাইয়ারচর মৌজায় এলএ কেস নম্বর ৫/১৯-২০ এর ১৫৮২৩৯ নম্বর চেকে ১ কেটি ৮৮ লাখ ১৪ হাজার ৩০০ টাকা। ১৫৮৬৪০ নম্বর চেকে ৩২ লাখ ৫৫ হাজার ৯৭৩ টাকা। ১৫৮৪৬২ নম্বর চেকে ৬৪ লাখ ৭৬ হাজার ৫২৫ টাকা। এলএ কেস নম্বর ৪/১৫-১৬ এর ১৫৮৫৯৭ নম্বর চেকে ৪৩ লাখ ৩৮ হাজার ৬৯৫ টাকা। ১৫৮৬৪৫ নম্বর চেকে ৪৯ লাখ ১৭ হাজার ১৮৭ টাকা।

 

পাঁচ্চর মৌজায় ২ জুন ২০২১ তারিখের এলএ কেস নম্বর ৪/১৫-১৬-এর ১৫৮৫৯০ নম্বর চেকে ১৯ লাখ ৩৩ হাজার ৬৬ টাকা। ১৫৮৫৯৮ নম্বর চেকে ২০ লাখ ৮১ হাজার ৪১৭ টাকা। ১৫৮৬১৮ নম্বর চেকে ৩৪ লাখ ২১ হাজার ৭৭ টাকা।

 

সতেররশি মৌজায় এলএ কেস নম্বর ৪/১৫-১৬-এর ১৫৮৬৪২ নম্বর চেকে ৩৭ লাখ ৪৮ হাজার ৯৮৮ টাকা। ১৫৮৬২৬ নম্বর চেকে ৪৫ লাখ ২ হাজার ২৫৬ টাকা। ১৫৮৬২২ নম্বর চেকে ৪৫ লাখ ২ হাজার ২৫৬ টাকা। ১৫৮৬৪৯ নম্বর চেকে ১৮ লাখ ৩৪ হাজার ১৮ টাকা। ১৫৮৬৪১ নম্বর চেকে ২৮ লাখ ১২ হাজার ৭১৫ টাকা।

 

কেরানীবাট মৌজায় এলএ কেস নম্বর ১/১৮-১৯-এর ১৫৮৬১৬ নম্বর চেকে ২৪ লাখ ৮৫ হাজার ৬৯৩ টাকা। ১৫৮৬১৯ নম্বর চেকে ১৬ লাখ ৬২ হাজার ৮৪৩ টাকা। ১৫৮৬২৪ নম্বর চেকে ৫৩ লাখ ৯৯ হাজার ৯৫৫ টাকা। ১৫৮৬১৪ নম্বর চেকে ১৭ লাখ ১৪ হাজার ২৭২ টাকা। ১৫৮৬২০ নম্বর চেকে ৩৩ লাখ ৮ হাজার ৫৪৪ টাকা। ১৫৮৬১২ নম্বর চেকে ২৪ লাখ ৮৫ হাজার ৬৯৩ টাকা। ১৫৮৬২৮ নম্বর চেকে ৬২ লাখ ৪৮ হাজার ৫১৯ টাকা। ১৫৮৬১৩ নম্বর চেকে ২৪ লাখ ৮৫ হাজার ৬৯৩ টাকা। ১৫৮৬২৭ নম্বর চেকে ৩৩ লাখ ৮ হাজার ৫৪৪ টাকা। ১৫৮৬২৫ নম্বর চেকে ৩৩ লাখ ৮ হাজার ৫৪৪ টাকা। ১৫৮৬১৫ নম্বর চেকে ২৪ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯৩ টাকা

 

এইচ এম কাদের,সিএনএন বাংলা২৪