ই-পেপার | সোমবার , ১লা জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

গরিবের বউ

♦️অ্যাডভোকেট সাজ্জাদুল করিম♦

বয়স অল্প। বিধবা নারী। স্বামী মারা গেছেন কয়েকবছর পূর্বে। কি রোগে মারা গেছেন, সেটিও নির্ণয় করা যায়নি। টাকার অভাবে!

বিধবার বাবার বাড়ির আর্থিক অবস্থা আরো খারাপ। তাই স্বামীর ঘর আঁকড়ে ধরে নাবালক তিন সন্তান নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বর্বর সমাজ তাকে বাঁচতে দিলো কোথায়?

 

তিন সন্তান নিয়ে বিধবার সংসার বেশ ভালোই চলছিলো। নানামুখি টানাপোড়েন সত্বেও। অনেকটা পোকামাকড়ের ঘরবসতির মতো। এরপরও কারো প্রতি তার ছিলো না কোনো অভিযোগ, কোনো অনুযোগ।

 

বিগত রমজানের আগে একদিন এক ধর্ষক দুর্বৃত্ত হানা দেয় বিধবার কুঁড়েঘরে। কক্সবাজার সদর উপজেলার পিএম খালি ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এক গ্রামে। নীর-নিস্তব্ধ ঝড়ো এক রাতে। গরিবের ঘর। ঘেরা-বেড়া, দরজার বালাই নেই। নেই কোনো জানালা কিংবা আচ্ছাদন। তাই সহজেই ভাঙ্গা দরজা দিয়েই ঢুকে ধর্ষক-দুর্বৃত্ত।

 

ঘরে ঢুকেই আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ে বিধবার উপর। তিন নাবালক সন্তান তখন গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন। বিধবা চিৎকার দিতে চাইলে ধর্ষক গলায় ছুরি ধরে। এরপরও বিধবা সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করে। এত সহজলভ্য বিধবার সতীত্বহরন! কঠিন হতে দেখে ধর্ষক এবার করে ভিন্ন পরিকল্পনা। ধর্ষক কোনো ভানিতা না করে তিন সন্তানকে গলা কেটে হত্যার হুমকি দেয়। প্রানপ্রিয় সন্তানদের খুনের হুমকির প্রেক্ষিতে বিধবার সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে। এরপর দুষ্কৃতকারী-ধর্ষক দ্রুপদী বিধবার ইজ্জত, সম্ভ্রম, সম্মান সব লুট করে।

 

নারীর অনন্য ভূষণ সম্ভ্রম হারানোর পর বিধবা একবার আত্মহননেরও চিন্তা করে। পরক্ষণেই নাবালক সন্তানদের কথা চিন্তা করে সেটি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেয়। কিন্তু এভাবে কয়দিন থাকা যাবে? সে যে দ্বিতীয়বার ধর্ষণ করতে আসবে না তার গ্যারান্টি কি? তাই বিধবা কয়েকজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের সাথে পরামর্শ করে স্হানীয় ইউপি মেম্বারের নিকট নালিশ দেয়। কারণ মামলা করার সামর্থ্য বিধবার নেই। তিনবেলা খাবার জোটে না। আবার মামলার খরচ যোগাবে কে?

 

ইউপি মেম্বার একজন যথার্থ ভাল লোক। পিএম খালি ইউনিয়নেরই সদয় এক মেম্বার। তিনি ধর্ষককে নোটিশ করেন। ধর্ষক প্রভাবশালী। তার আবার একজন গডফাদারও আছেন। ধর্ষক সার্বক্ষণিক গডফাদারের সাথেই থাকেন। গডফাদারের স্ত্রী আবার মহিলা কোটায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। তাই ধর্ষকের পোয়াবারো।

 

একদিকে মেম্বার তার ক্ষমতার সবটুকু ব্যবহার করে ধর্ষকের নিকট হতে মুচলেকা আদায় করেন। ভবিষ্যতে এমন কাজ সে আর করবে না, মুচলেকায় ছিলো তেমনই শর্ত। এভাবে বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হয়। মহিলাও ভুলে যেতে চায় দুঃসহ সেই রাতের স্মৃতি। কিন্তু চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনী!

 

ধর্ষক আবারও বিধবাকে ধর্ষণের মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। যথারীতি ধর্ষক বিধবাকে আবারো ধর্ষণ করতে আসে একদিন। এবারও রাতের নীরবতাকেই সে বেছে নেয়। বিধবা এবার কোনো সুযোগ দিতে নারাজ। বিধবার প্রবল প্রতিরোধে ধর্ষক ব্যর্থ মনোরথে ফিরে যায়। ব্যর্থতা জন্ম দেয় প্রতিহিংসার। ধর্ষক প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলতে থাকে। যে কোনোভাবেই বিধবার উপর প্রতিশোধ নিতে হবে।

 

বিধবাও অনুমান করে ভয়ংকর কিছুর। পরদিন সকালেই ধর্ষক বিধবার চার বছরের শিশুকে নৃশংসভাবে তলপেটে লাথি দিয়ে বসে। কেন লাথি দিয়েছে তার খোঁড়া অজুহাতও যেনো প্রস্তুত ছিল। বিধবার চার বছরের শিশু ধর্ষকের তার আট বছরের ছেলেকে নাকি মারধর করেছে! অনেকটা নেকড়ে ও মেষশাবকের গল্পের মতো। যেনো উপযাচক হয়ে ঝগড়া করবে।

 

ব্যথায় বিধবার অবুঝ সন্তান কাতরাতে থাকে। বিধবা মা এসে প্রতিবাদ করে। ধর্ষক এমন সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো। প্রকাশ্যে দিবালোকে ধর্ষক এবার বিধবাকে প্রায় ত্রিশ মিনিট যাবৎ নৃশংসতা ও নারকীয়তার সব সীমা ছাড়িয়ে মারধর করে। শরীরের কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সে বাদ রাখেনি। বিধবার সর্বাঙ্গে জখম। ধর্ষকের মূল আঘাতগুলো আবার বিধবার বুক ও গোপনাঙ্গ লক্ষ্য করে।

 

আইয়ামে জাহেলিয়াতের এমন বর্বরতা চলল অনেকক্ষণ। কেউ ধর্ষককে নিবৃত্ত করলো না। কেউ বাধা দিলো না। সবাই যেনো নীরব দর্শক মাত্র। ধর্ষকের পিতা, চাচা, ভাই, স্ত্রী আরো একধাপ এগিয়ে। তারা সরাসরি অপরাধের সহযোগীর ভুমিকায অবতীর্ণ হলো।

 

অল্প বয়সী বিধবা আজ হাসপাতালের মলিন বিছানায় ব্যথায় জর্জরিত। হাসপাতালের স্বল্প ব্যয়ভার বহনের ক্ষমতাও তার নেই। অন্যদিকে অপরাধী হায়েনারা আছে মহাআনন্দে। কারণ তারা জানে, অন্য সব অপরাধের মতো ধর্ষণ, গুরুতর আঘাতের এই অপরাধের বিচারও হয়তো হবে না কখনো।

 

মুখথুবড়ে পড়ে থাকবে বিধবার অভিযোগ। কারণ বিধবা গরিব। গরিবের আবার কিসের ইজ্জত? গরিবের বউ যে আমার আপনার, সবার ভাবি! দ্বিতীয়ত, বিচারহীনতার সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে সমাজে। কথায় বলে- Law is the slave of riches. কিন্তু আমি অন্য ধাতুতে গড়া। আমি পিছপা হবো না। যত বাধা-বিপত্তি আসুক না কেনো, বিধবার ন্যায় প্রতিষ্ঠার আমার এই সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে বহুকাল।

লেখক: অ্যাডভোকেট সাজ্জাদুল করিম,
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সিনিয়র আইনজীবী