সিএনএন বাংলা২৪:
চলতি বছরের ফ্রেব্রুয়ারিতে একটি মামলায় ১৭ দিন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলেন নেজাম উদ্দিন। এজন্য তিনি কারা হাসপাতালে মাসিক ২৫ হাজার টাকায় সিট ভাড়ার চুক্তি করেন। ছিলেন ১১ নম্বর ওয়ার্ডে। তবে বিশুদ্ধ পানি, ভালো খাবারের জন্য দিতে হতো আলাদা টাকা। আর টাকা দিতে দেরি হলেই চলতো নির্যাতন। তিনি বলেন, ‘ফটিকছড়ির এক চেয়ারম্যান ও জানে আলম নামের এক ব্যবসায়ীকে কারাগারে টাকার জন্য নির্যাতন করা হয়। এছাড়া সন্দ্বীপের এক চেয়ারম্যানের কাছ থেকেও এক মাসে আদায় করা হয় এক লাখ ২০ হাজার টাকা। এসব বিষয়ে জেলারকে বিচার দিলে বেড়ে যায় নির্যাতনের মাত্রা।’
চট্টগ্রাম কারাগারে এভাবে টাকার বিনিময়ে সুবিধা নেন বন্দিরা। এসবের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে তিন কয়েদির সিন্ডিকেট। তিনজনের এই সিন্ডিকেটের সদস্যদের টাকা দিলে কারাগারে ‘জামাই আদর’ পাওয়া যায়। আর টাকা না দিলে কপালে জোটে নির্যাতন। জেলখানার আসামিদের ওয়ার্ডে সিট পেতে হলে টাকা দিতে হয় সিন্ডিকেটের হাতে। এমনকি কারা হাসপাতালের বেডে কে থাকবে তা টাকার বিনিময়ে নির্ধারণ করে দেন ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা। ফলে করুণদশায় দিন কাটাতে হয় অসুস্থ রোগীদের। এভাবে প্রতিমাসে প্রায় কোটি টাকার ‘চাঁদাবাজি’ হয় কারাগারে, এসব কারাবন্দি যেন তাদের কাছে টাকার গাছ।
জানা গেছে, ১০০ শয্যার কারা হাসপাতালের অসুস্থ বন্দিদের চিকিৎসা দেওয়ার কথা থাকলেও সেখানে সুস্থ ধনাঢ্য ব্যক্তিদের মাসিক চুক্তিতে ব্যবস্থা করে দেওয়া হয় থাকা-খাওয়ার। এজন্য মাসে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা দিতে হয় জনপ্রতি। টাকার জন্য শারীরিক, মানসিক নির্যাতন করা হয় বন্দিদের। এই টাকার ভাগ যায় হাসপাতালের ডাক্তার, জেলারসহ বিভিন্ন জায়গায়। টাকা দিলে আয়েশি জীবনযাপন করা যায় কারাগারে। আর এসব কিছুর নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ছাত্রদল ক্যাডার মাসুদ (চিফ রাইটার-মেডিকেল), সোহেল (রাইটার-পত্র শাখা) এবং শাহেদ (রাইটার-মেডিকেল)। এদের মধ্যে মাসুদ ও সোহেল দু’জন আপন ভাই।
মঙ্গলবার (৪ জুলাই) সরেজমিন চট্টগ্রাম কারাগারে গিয়ে সাক্ষাৎ করতে আসা বিভিন্ন বন্দির পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
কারাগার থেকে সদ্য মুক্তি পান বাঁশখালীর আক্তার হোসেন। ছয় মাসের সাজা হয়েছিল তার। মঙ্গলবার দুপুরে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘কয়েদি হিসেবে ছয় মাস সাজাকালীন দেখেছি, কারাগারে আসা নতুন বন্দিদের কেইস টেবিলে বিভিন্ন ওয়ার্ডের ম্যাট-রাইটাররা টাকা দিয়ে কিনে নেন (জেলের ভাষায় গরু কেনা)। তারপর ওয়ার্ডে নিয়ে টাকার অঙ্কের রফাদফা করা হয়। বন্দিদের পরিবারের নম্বর নিয়ে কারাগার অথবা কারারক্ষীদের মাধ্যমে ফোনে সাক্ষাৎ করতে আসতে বলেন। সেখানে নেওয়া হয় টাকা। অভিযুক্ত কয়েদিরা কারাগারে গোপনে ফোন ব্যবহার করেন।’
তেমনই এক কয়েদির স্ত্রী জেসমিন আক্তার। গত ৪ জুলাই তিনি তার স্বামীর সঙ্গে কারাগারে সাক্ষাৎ করতে আসেন। এর দু’দিন আগে তার স্বামীকে ডাকাতি মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়। রাতে কারাগার থেকে এক ব্যক্তি তাকে ফোনে জানান, তার স্বামী কারাগারের একটি ওয়ার্ডে আছেন। দেখা করার সময় ১০ হাজার টাকা আনতে বলেন। জেসমিন পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে যান এবং এক সপ্তাহ পর বাকি টাকা দেবেন বলে জানান।
কারাগার সূত্রে জানা গেছে, কারাগারের বন্দির ধারণ ক্ষমতা ২ হাজার ২৪৯ জন হলেও বর্তমানে সেই সংখ্যা দ্বিগুণ ছাড়িয়েছে। চলতি বছরের ৪ জুলাই পর্যন্ত কারাগারে বন্দির সংখ্যা ৫ হাজার ৫২ জন। যার মধ্যে নারী কয়েদি রয়েছেন ২২১ জন। কারাগারে বন্দিদের পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, কর্ণফুলী, সাঙ্গু ওয়ার্ডে ভাগ করে রাখা হয়। এছাড়া কারা হাসপাতালে ১০০ শয্যা রাখা হয়েছে অসুস্থ বন্দিদের জন্য। সূত্রে- চট্টগ্রাম প্রতিদিন
কারাগারের জেলার মো. এমরান হোসেন মিঞা কয়েদিদের সিন্ডিকেটের বিষয়টি স্বীকার করলেও টাকার ভাগ পাওয়া বিষয়টি অস্বীকার করেন।
কারাগারে সিন্ডিকেট, চাঁদা আদায় প্রসঙ্গে সিনিয়র জেল সুপার (ভারপ্রাপ্ত) মুহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন বলেন, ‘দ্রুত অভিযুক্ত কয়েদিদের অন্যত্র পাঠানো হবে। কারাগারে শৃঙ্খলা রক্ষায় সিন্ডিকেট ভেঙে চাঁদাবাজিসহ সব ধরনের অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবো।’
নুর মোহাম্মদ, সিএনএন বাংলা২৪