ই-পেপার | মঙ্গলবার , ১৮ই জুন, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

আইন পেশার একাল, সেকাল

@ অ্যাডভোকেট সাজ্জাদুল করিম @

দুই হাজার সালের শুরুর দিকে আইন পেশায় যুক্ত হই। তবে আইন পেশা কখনো আমার অগ্রাধিকারে ছিলো না। অনেকটা ভাগ্যের পরিহাসে এই পেশাতে সম্পৃক্ত হই। আমার প্রথম চয়েস ছিলো- বিচারক হওয়া। বিচারকের জীবনে অর্থ কম, সম্মান বেশি। আবার আইনজীবীর ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পুর্ণ বিপরীত। আইন পেশায় সম্মান কম, অর্থ বেশি। কিন্তু বিধাতা হয়তো আমার জন্য দ্বিতীয়টি ভেবে রেখেছিলেন।

অতীতে আইন পেশা ছিলো বেশ সমৃদ্ধ ও গৌরবময় মহান এক পেশা। নিকট অতীতেও অনেক খ্যাতিমান, তারকা আইনজ্ঞ এই পেশায় যুক্ত ছিলেন। একসময় টেকনাফের সাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট নুর আহমদ সাহেব, সাবেক মহকুমা গভর্নর অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম, খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ ও আইনজ্ঞ প্রফেসর নুর আহমদ সাহেব, আমার মামা স্বনামধন্য প্রাক্তন পাবলিক প্রসিকিউটর, বহু আইন গ্রন্হের প্রণেতা জাহাঙ্গীর সাহেব আইন পেশায় খ্যাতির মধ্য গগনে ছিলেন।

 

প্রথম দুজন পরপারে। তৃতীয়জন বয়সের ভারে ন্যুজ। এখন কেবল প্রাক্তন পিপি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর সাহেবই শীর্ষ আইনজীবী হিসাবে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। তারও আগে জনাব ফিরোজ মিয়া, বাবু জ্যোতিশ্বর চক্রবর্তী, আবু আহমদ, মওদূদ উকিল, মোহাম্মদ আলী উকিল প্রমুখ আইনজীবীগণ আইন পেশাকে আলোকিত করেছেন।

 

পেশার প্রথম পর্যায়ে একজন আইনজীবী পরিচয়ে আমার কোনো নেতিবাচক ধারণা ছিলো না। কালক্রমে আইন পেশার মান ক্রমশ নিম্নমুখী হতে থাকে। অনেক সমাজবিরোধী, মাফিয়া, মামলার আসামি আইন পেশায় প্রবেশ করেছেন। যার অনিবার্য পরিণতিতে আইন পেশা আজ প্রশ্নবিদ্ধ।

 

অতীতে রাজনৈতিক কারণ ছাড়া কোনো আইনজীবী জেলে যান নি। আইনজীবীরাও আইন যাতে ভঙ্গ না হয়, এমন বিষয়ে সচেতন-সতর্ক থাকতেন। ফলে আইনজীবীদের সবাই সমীহ করতেন। হালে কতিপয় আইনজীবী এসবের ধারে নেই। অনিবার্য কারণে প্রতারণা, জালিয়াতি, চাঁদাবাজির মতো অপরাধে বেশ কয়েকজন আইনজীবীকে জেলে যেতে হয়েছে। এতে চরমভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে আইনজীবী সমাজের ভাবমূর্তি।

 

আইন পেশার অধঃপতনের ক্ষেত্রে বার কাউন্সিলের ভুমিকাও কম নয়। আইন পেশাটিকে বার কাউন্সিল একেবারে সস্তা করে দিয়েছে। যে কেউ চাইলে আইন পেশায় আসতে পারে। এলএলবি পাসের ন্যুনতম মানদণ্ড নেই। নেই পরীক্ষা ব্যবস্হাপনার উপযুক্ত তদারকি। রাজনৈতিক মামলা ছাড়া একাধিক মামলার আসামি হলে আইন পেশায় নিষিদ্ধ করা দরকার। পরীক্ষার সবক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিভাগ ছাড়া আইনজীবী নিবন্ধন বন্ধ রাখতে হবে। আইন পেশার প্রবেশের ক্ষেত্রে ন্যুনতম বয়সসীমা উল্লেখ থাকতে হবে। কিন্তু বার কাউন্সিল কোনকিছুই করবে না। তাদের কাজ কেবল ভোটার বৃদ্ধি করা।

 

প্রায় দুই যুগের কাছাকাছি আইন পেশায় রয়েছি। কিন্তু কোনোদিন কোনো বিচারকের খাসকামরায় যাইনি। জিআর শাখা, কোর্ট হাজতঘরও কখনো আমি স্বচক্ষে দেখিনি। আদালত ভবনের সন্নিকটে বিশাল চত্বর জুড়ে রয়েছে কক্সবাজার সদর থানা। বহুল আলোচিত সেই থানার ভেতরে যাওয়ার সৌভাগ্যও হয়নি কখনো। থানা কেবল দূর হতেই অবলোকন করেছি। অনেকটা দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর মতো।

 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এলএলবি (অনার্স) এর প্রথম ব্যাচের আমি এক বিবর্ণ প্রাক্তন ছাত্র। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার তিনজন ব্যাচমেট জেলা জজ পদমর্যাদায় এই আদালত পাড়াতেই রয়েছেন। ওই সমস্ত কোর্টের অসংখ্য মামলা প্রতিদিন আমার নিকট আসে। কিন্তু একটি দিনের জন্যও আমি সেই কোর্টগুলোতে যাইনি। যদিও সততা, দক্ষতা, মানবিকতায় আমার তিন ব্যাচমেটই বাংলাদেশের বিচার বিভাগের রত্ন ও অহংকার।

 

এসব কারণে আদালতে সবচেয়ে বেশি মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীর একজন হয়েও আমি গরিব। এই শহরে আমার নিজের নেই কোনো বাড়ি। নেই গাড়ি। টেকপাড়ায় আমার মরহুম বাবার একটি আটপৌরে টিনসেড বাড়ি আছে। যেখানে আমি বড় হয়েছি। সেই স্মৃতিধন্য বাড়িটিও আমাকে বিত্তশালী মনে করে আমার অন্য আত্মীয়রা করতলগত করে রেখেছেন।

 

পেশায় নবাগত কিংবা মধ্যমমানের অনেক আইনজীবীরও বাড়ি, অর্থবিত্ত রয়েছে। একটু সিনিয়রদের রয়েছে বহুতল ভবন, গাড়ি। প্রচুর অর্থ, বাড়ি, গাড়ি না থাকলেও আমার কোনো অনুশোচনা নেই। নেই কোনো অনুযোগ। আমার আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন, অনেকের তাও নেই। বিখ্যাত কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের ভাষায়-

পরের অভাব মনে করিলে চিন্তন
আপন অভাব ক্ষোভ রহে কতক্ষণ?

লেখক: সাজ্জাদুল করিম,
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সিনিয়র আইনজীবী।