বিশেষ প্রতিবেদক:সিএনএন বাংলা২৪:
কক্সবাজার পৌরসভার নির্বাচন আগামীকাল ১২ জুন। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পুরো পর্যটন নগরীর পাশাপাশি আশপাশের এলাকাগুলোতে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। প্রতিদ্বন্দ্বী মেয়র প্রার্থীদের পাশাপাশি কাউন্সিলর প্রার্থীদের নানামুখি প্রচার-প্রচারণায় মুখর ছিলো পৌরসভার প্রতিটি এলাকা ও পাড়া-মহল্লা। এলাকার বিভিন্ন দোকান, রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে রাস্তা-ঘাট, অফিস-আদালত ও গণপরিবহনে সকলের মধ্যে আলোচানার মূল বিষয় ছিলো কক্সবাজার পৌরসভার এবারের নির্বাচন।
জানা যায়, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ প্রধান দলগুলোর অংশগ্রহণবিহীন এবারের নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক দুই সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান চৌধুরী ও মাশেদুল হক রাশেদ। এ দু’জনের মধ্যে মাহবুবুর রহমান চৌধুরী দলীয় প্রতীক নৌকা নিয়ে ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নাগরিক কমিটির ব্যানারে মাশেদুল হক রাশেদ নারকেল গাছ প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
ওই দুই প্রার্থী ছাড়া অন্য তিন প্রার্থী হলেন-ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত হাতপাখা প্রতীকের মাওলানা জাহেদুর রহমান, হেলমেট প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী জগদীশ বড়ুয়া ও মোবাইল ফোন প্রতীকে মাশেদুল হক রাশেদের সহধর্মিণী জোসনা হক।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, নাগরিক কমিটির প্রার্থী মাশেদুল হক রাশেদ ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাহবুবুর রহমান চৌধুরী পুরোদমে প্রচারণা চালিয়েছেন। নিয়মিত ক্যাম্পেইন ও উঠোন বৈঠক করেছেন। তবে, এই দুই প্রার্থী প্রচারণা চালাতে গিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদগার ও কুটসা রটিয়েছেন বেশি- এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ভোটারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কক্সবাজার পৌরসভায় বিএনপি ও সমমনা সমর্থিত ভোটারদের আধিক্য রয়েছে। এই হার প্রায় ৬০ শতাংশ। অপরদিকে আওয়ামী লীগের ভোটার সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ। এই হিসাব অনুযায়ী ২৫-৩০ শতাংশ ভোট মাহবুবুর রহমান চৌধুরী তথা নৌকায় পড়বে। অপরদিকে বাকি ১৫ শতাংশ আওয়ামী লীগ সমর্থিত ভোট ও বিএনপি-সমমনাদের ভোট একচেটিয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী, নারকেল গাছ প্রতীকের মাশেদুল হক রাশেদ পাবেন। সেই হিসাব অনুযায়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী রাশেদের জয়ের সম্ভাবনা অনেকটা উজ্জ্বল।
আবার অনেক ভোটারের অভিমত, মাহবুব ও রাশেদ একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। এই দুজনের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবার সম্ভাবনাই বেশি।
ভোটাররা বলছেন- কক্সবাজার পৌরসভা নির্বাচনে এবারে বিএনপি ও জামায়াত কোনো প্রার্থী দেয়নি। এছাড়া আরেক হেভিওয়েট প্রার্থী, সাবেক মেয়র সরওয়ার কামালও প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। তাই আওয়ামী লীগের সাবেক দুই সাংগঠনিক সম্পাদকের মাঝেই লড়াইটা হবে হাড্ডাহাড্ডি।
তবে স্থানীয়ভাবে বেশি আলোচনা চলছে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মাসেদুল হক রাশেদকে নিয়ে। বর্তমান মেয়র মুজিবুর রহমানের পারিবারিক সদস্য হওয়ায় এলাকায় তার একটা প্রভাব রয়েছে। এছাড়া তার প্রয়াত পিতা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর একেএম মোজাম্মেল হককে জেলার আওয়ামী লীগের আতুড়ঘর বলা হয়।
অপরদিকে মাহবুবুর রহমান চৌধুরী জেলা ছাত্রলীগ ও জেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং সর্বশেষ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে মাহবুবুর রহমানের নিজস্ব একটি অবস্থান রয়েছে। এছাড়া তিনি গত তিনবারের কাউন্সিলর এবং ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সব মিলিয়ে পৌরসভার কর্মকাণ্ড পরিচালনা এবং পৌরবাসীর সঙ্গে তার সখ্যতাও কম নয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা ও রাজনৈতিক বোদ্ধামহল জানিয়েছেন, কাজ করতে গেলে সমালোচনা হয়। নানা কারণে বিতর্কিত হলেও কক্সবাজারে জনপ্রিয় প্রার্থী ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মেয়র মুজিবুর রহমান। তবে দুর্নীতির অভিযোগে দুদকে মামলা চলায় তিনি মনোনয়ন থেকে বাদ পড়েছেন। এছাড়া পৌরসভা কার্যালয়ে তার নিজস্ব লোকজনের বেশি ভিড় এবং মেয়রকে সহজে কাছে না পাওয়াও তার বাদ পড়ার কারণ হতে পারে। তার বাদ পড়াকে লজ্জাজনক দেখে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আমৃত্যু আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বে থাকা একেএম মোজাম্মেল হকের বড় ছেলে রাশেদকে স্থানীয়রা ভোটের মাঠে নামান। পৌরসভার ১,২,৩ নম্বর ওয়ার্ডকে তারা ভোটব্যাংক হিসেবে গণ্য করে সহজ জয়ের আশা করছেন।
অপরদিকে নৌকার মনোনয়ন পাওয়া মাহবুবুর রহমান সাতকানিয়া-লোহাগাড়া কেন্দ্রিক ব্যবসায়ী সংগঠন কক্সবাজার দোকান মালিক সমিতি ফেড়ারেশনের সভাপতি। বাবার ব্যবসায়িক পরিচিতির সূত্র ধরে সরকারি দলের নেতা ও স্থানীয় কাউন্সিলর হিসেবে সাংগঠনিক সুবিধার আশায় ব্যবসায়ীরা তাকে গতবার সমিতির সভাপতি করেন। এটিই তার জন্য এখন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে! এটাকে এখন হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী মাসেদুল হক রাশেদ। এর ফলে অনেকটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে মাহবুবুর রহমানের নির্বাচনী মাঠে।
এদিকে এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীই হেভিওয়েট এবং আওয়ামী ঘরানার হওয়ায় আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও কিছুটা দ্বিধাবিভক্ত অবস্থায় রয়েছেন। এতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল। শীর্ষ নেতারা নৌকার প্রার্থী মাহবুবুর রহমান চৌধুরীর জন্য কাজ করলেও তৃণমূলের বহু নেতাকর্মী প্রকাশ্যে মাসেদুল হক রাশেদের জন্য কাজ করেছেন। এই জন্য ওয়ার্ড কমিটি সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক চিহ্নিত ১৩ নেতাকে দল থেকে বহিষ্কারও করেছে পৌর আওয়ামী লীগ। বহিষ্কার করা হয় জেলা ও পৌর স্বেচ্ছাসেবক লীগের ১৫ নেতাকেও। নৌকার জন্য কাজ করা অনেকে ভেতরে ভেতরে নারিকেল গাছ প্রতীককেই ভোট দেবেন- এমনটি শোনা যাচ্ছে।
সেই হিসেবে নৌকার প্রার্থী মাহবুবুর রহমান চৌধুরীর চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন মাসেদুল হক রাশেদ। প্রথমত, তার একটি বিশাল নিজস্ব ভোট ব্যাংক রয়েছে। সেই সাথে আওয়ামী লীগের একটি অংশ ভোট দেবে। এছাড়া বিএনপি-জামায়াতের ভোটও তার বাক্সে পড়তে পারে বলে সচেতন মহল ধারণা করছেন। তবে মাহবুবুর রহমান চৌধুরীর পৈত্রিক বাড়ি চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় হওয়ায় আঞ্চলিকতার একটা প্রভাবও রাশেদের পক্ষে কাজ করছে।
আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী মাহবুবুর রহমান চৌধুরী বলেন- ‘আমার জন্ম কক্সবাজারে। আমার পিতা ব্যবসায়ী হিসেবে এই অঞ্চলের পরিচিত মুখ। পূর্ব পুরুষের বাড়ি লোহাগাড়ায় হওয়ায় কক্সবাজারে ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার লোকজন আমাদের আপন। এছাড়া আমারও দৃষ্টি পৌরসভার উন্নয়ন। তাই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষায় সাধারণ মানুষ নৌকাকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করবে’।
নাগরিক কমিটির প্রার্থী মাসেদুল হক রাশেদ বলেন- ‘জনগণই আমাকে ভোটে নামিয়েছে। জনগণ ভোট দিতে পারলে আমার বিজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না। আমার প্রয়াত পিতা একেএম মোজাম্মেল হকের দেখানো পথে পৌরবাসীর সেবায় থাকতে চাই’।
কক্সবাজার পৌরসভা নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা এসএম শাহাদাত হোসেন বলেন- ‘কক্সবাজার পৌরসভার ১২টি ওয়ার্ডে ভোটার সংখ্যা ৯৪ হাজার ৮০২ জন। যার মধ্যে পুরুষ ভোটার ৪৯ হাজার ৮৭৯ ও নারী ভোটার ৪৪ হাজার ৯২৩ জন। ১২টি ওয়ার্ডের ৪৩টি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণ হবে’।
তিনি বলেন, নির্বাচনী আচরণবিধি নিয়ে কমিশন কঠোর অবস্থানে রয়েছে। আচরণবিধি লঙ্ঘন না করতে প্রার্থীদের কঠোর হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে।
কক্সবাজার পৌরসভার সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় বিগত ২০১৮ সালের ২৫ জুলাই। ওই নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় প্রতীক নৌকা নিয়ে নির্বাচিত হন কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান।
এইচ এম কাদের,সিএনএন বাংলা২৪: