ই-পেপার | শনিবার , ২৯শে জুন, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

রাঙ্গুনিয়ায় অবসান হচ্ছে না পাহাড় নির্মূলের মহোৎসব

রাঙ্গুনিয়া (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি:

পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে পাহাড় কাটার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় অনেকেই তা মানছেন না। একাধিক স্থানে সিন্ডিকেট করে অভিনব পন্থায় চলছে পাহাড় ও কৃষি জমির টপ সয়েল কাটার মহা উৎসব। পরিবেশ অধিদফতরের কঠোর নজরদারিতেও থামানো যাচ্ছে না পাহাড় ও টপ সয়েল কাটা মহোৎসব। উল্টো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অগোচরে বেড়েই চলেছে একের পর এক পাহাড় ও টপ সয়েল কাটার ঘটনা। ইটের ভাটা, পুকুর ভরাট ও ইমারত নির্মাণের প্রতিযোগিতায় পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষাকারী পাহাড় ও টপ সয়েলকে উৎসবের বলী হিসেবে দিচ্ছে বিসর্জন।

 

১১মে (শনিবার) উপজেলার সরফভাটা ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ড রূপনগর এলাকায় পাহাড় কাটার অভিযোগ উঠেছে, ওই একই এলাকার মৃত নুরুন্নবীর ছেলে জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে।

 

এস্কেভেটর দিয়ে উক্ত পাহাড় কাটার ঘটনাটি স্থানীয় সচেতন মহলের দৃষ্টিগোচর হলে, প্রথমে উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রায়হান মেহেবুবকে অবহিত করলে তিনি উপজেলার সহকারী ভূমি ম্যাজিস্ট্রেট মারজান হোসাইনকে পাঠায়, তিনি দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া থানা এএসআই জিলানিকে পাহাড় কাটার কাজ বন্ধ করে দিলেও স্থানীয়দের দাবি রাতের অন্ধকারে এসব পাহাড় কাটার মহোৎসব চলতে থাকে।

 

সরফভাটা ইউনিয়ন ৯নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোহাম্মদ খোকন জানান, “জাহাঙ্গীর আলমের খতিয়ানভূক্ত জায়গা এটি, তারা জায়গা তাদের পার্শ্ববর্তী জায়গাতে ভরাট করতেছেন।”

 

উপজেলা সহকারী ভূমি ম্যাজিস্ট্রেট মারজান হুসাইন বলেন, খবর পেয়ে তৎক্ষণাৎ পাহাড় কাটার কাজ বন্ধ করেছি, পাহাড়ের মাটি কেটে শ্রেণি পরিবর্তন করা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ, এই আইনে জরিমানা ও শাস্তির বিধান আছে, ভবিষ্যতে একই কাজ দ্বিতীয়বার করলে সংশ্লিষ্ট জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রায়হান মেহেবুব বলেন, পাহাড় ও কৃষি জমির টপ সয়েল কাটা সম্পূর্ণ বেআইনি কাজ। এটি কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা ইতিমধ্যে একাধিক অভিযান চালিয়ে জরিমানাসহ মাটি কাটার এস্কেভেটর নষ্ট করেছি। সম্প্রতি দক্ষিণ রাজানগরে অভিযান চালিয়ে একটি এস্কেভেটর নষ্ট করা হয়েছে। এসব চক্র প্রশাসনের লোক দেখলে পালিয়ে যায়। যার ফলে তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয় না। তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

 

উল্লেখ্য, উপজেলার সরফভাটা, কোদালা, রাজানগর, ইসলামপুর, দক্ষিণ রাজানগর, পারুয়া, পোমরা, লালানগর, চন্দ্রঘোনা ইউনিয়নের একাধিক স্পটে চলছে সমানতালে পাহাড় কাটা ও কৃষি জমির টপসয়েল কাটা হচ্ছে। এর মধ্যে ভয়াবহ অবস্থা সরফভাটা, ইসলামপুর, রাজানগর ও দক্ষিণ রাজানগর ইউনিয়নে। এখানে এক প্রকার প্রকাশ্যে কাটা হয় পাহাড় ও ফসলি জমি।

 

রাঙ্গুনিয়ায় প্রশাসনের একাধিক অভিযানের পরও পাহাড় ও কৃষি জমির মাটি কাটা বন্ধ হচ্ছে না। অভিযোগ আছে, রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় প্রভাবশালী মহল সিন্ডিকেট করে চালায় মাটি কাটার কার্যক্রম। প্রশাসন অভিযান চালিয়ে জরিমানা করলেও থেমে নেই ভূমিদস্যুদের তৎপরতা। মূলত অবৈধ ইটভাটা, পুকুর ভরাট, ইমারত নির্মাণ ভরাট কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে এসব মাটি। ফলে পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষার পেরেক পাহাড় সাবাড় হচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে কৃষি জমি, বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ।

 

সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপরে উল্লেখিত একই ওয়ার্ডের পার্শ্ববর্তী গ্রাম ‘উরুল্লেপাড়া’ পাহাড় অধ্যুষিত এই গ্রামের দুইটি স্পটে বিপজ্জনকভাবে কাটা হয়েছে পাহাড়। এর কিছুদূর গেলেই সরফভাটা আশ্রম প্রকল্পের পাশে বিশালাকার কৃষি কাজে ব্যবহৃত ফসলের জমি এবং পাহাড়ে বেষ্টিত এলাকাটি পাহাড়ে ঘেঁষে রয়েছে একটি ইটের ভাটা, এতে প্রতিনিয়ত পোড়ানো হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান মূল্যবান গাছ। এছাড়াও ইটের ভাটার পার্শ্ববর্তী পাহাড়টি অর্ধেক কেটে তৈরি হয়েছে ইমারত নির্মাণের অন্যতম উপাদান ইট।

 

এছাড়াও সরফভাটা ইউনিয়ন ১নং ওয়ার্ড মীরেরখীল এলাকায় একাধিক ইটভাটায় একই চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। বনবিভাগের মালিকানাধীন একাধিক পাহাড় খাঁড়াভাবে কেটে সাবাড় করা হচ্ছে এখানে।

 

স্থানীয়দের অভিযোগ, ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে অর্থদণ্ড ছাড়া কঠোর কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় বন্ধ হচ্ছে না মাটি কাটা। কর্তনকারীরা প্রভাবশালী। তাদের ভয়ে স্থানীয় সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করার সাহস করে না। এমনকি বন বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকেও এক্ষেত্রে তেমন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। স্থানীয় জনসাধারণ জানান, পাহাড় ও ফসলি জমি কাটতে অভিনব কৌশলের আশ্রয় নেয় এসব দস্যু। বিভিন্ন এলাকায় ৮/১০ জনের একেকটি সিন্ডিকেট প্রথমে জমির মালিককে অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে কিছু জমি টার্গেট করে। পরে সেটিকে এস্কেভেটরের মাধ্যমে গভীর করে খনন করে মাটিগুলো বাইরে বিক্রি করে। গভীর খাদের ফলে একটু বৃষ্টিতেই আশপাশের বাকি জমিগুলো ধীরে ধীরে ভেঙে যায়। যার ফলে শস্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় বাকিরাও বাধ্য হয়ে মাটি বিক্রি করে দেয় তাদের কাছে। এক পর্যায়ে পুরো বিলে এসব ভূমিদস্যুর থাবা বসে।

 

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০১০ এ বলা হয়েছে, পাহাড় কাটা আমলযোগ্য অপরাধ। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পূর্ব অনুমতি ছাড়া কোনও সরকারি, আধা-সরকারি, সায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান অথবা ব্যক্তি পাহাড় কাটতে বা নিশ্চিহ্ন করতে পারবে না। যদি কেউ এটি অমান্য করে, তবে তাকে অথবা ওই প্রতিষ্ঠানকে দুই বছর কারাদণ্ড অথবা ২ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। ফের একই অপরাধ করলে, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ১০ বছর কারাদণ্ড অথবা ১০ লাখ জরিমানা গুণতে হবে।

 

অন্যদিকে, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-১৯৯৬ তে বলা হয়েছে, পাহাড় কাটা অথবা মোচনের জন্য পরিবেশ ছাড়পত্র অবশ্যই নিতে হবে। ২০০২ সালের ৯ মার্চ পরিবেশ অধিদফতর এই সম্পর্কিত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। যেখানে বলা হয়েছে পাহাড় কর্তন ও মোচনের ক্ষেত্রে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা -১৯৫২ এবং ১৯৯৬ অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে।