ই-পেপার | বৃহস্পতিবার , ২৭শে জুন, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বালুচর থেকে বেরিয়ে নোনাজলে ছুটছে কাছিম ছানারা

আলমগীর আকাশ,টেকনাফ প্রতিনিধি:

চলতি মৌসুমে কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে সংগ্রহ হয়েছে সর্বোচ্চ সংখ্যক সামুদ্রিক কাছিমের ডিম। বালুচরে গর্তে করে সংরক্ষণে রাখা এসব ডিম ফুটে বেরিয়ে আসছে কাছিমের ছানা। এরইমধ্যে হ্যাচারিগুলোতে জন্ম নিয়েছে অগণিত কাছিমের ছানা।

 

নেকম-ইকো লাইফ কার্যক্রম এবং হিমছড়ি সহব্যবস্থাপনা কমিটির সহযোগিতায় শুক্রবার (১৯ এপ্রিল) সন্ধ্যায় কক্সবাজারের রামু উপজেলার পেঁচার দ্বীপে ৩৫০টি কাছিমছানা সাগরে অবমুক্ত করা হয়। একইদিনে নেকম-আইবিএপি কার্যক্রম সোনাদিয়া দ্বীপে ২৫০টি, মাদারবুনিয়ায় ১৫০টিসহ মোট ৭৫০টি কাছিম ছানা সাগরে অবমুক্ত করা হয়।

 

আর সমুদ্রের নোনাজলের ছোঁয়া পেয়ে ছানাগুলো যেন আনন্দে আত্মহারা। আর সামুদ্রিক প্রাণী সংরক্ষণে নানা উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগ।

 

সরজমিনে দেখা যায়, রামু উপকূলের পেঁচারদ্বীপ সমুদ্রসৈকতের ঝাউবিথীর বালুচরে রয়েছে সামুদ্রিক কাছিম সংরক্ষণ ও প্রজনন কেন্দ্র। যেখানে সংরক্ষণ দুটি পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হয়েছে কাছিমের ডিম। একদিন-দু’দিন করে ৬৫ দিন পর বালুচর থেকে বেরিয়ে আসছে কাছিম ছানা। তাও আবার একটি-দুটি নয়; একই সঙ্গে বালুচরে গর্ত করে সংরক্ষণে রাখা ৩৫০টি ডিম ফুটে বেরিয়ে আসে কাছিম ছানা। মা কাছিম থেকে ডিম ফুটে যাওয়ার আগ পর্যন্ত দেখভাল করেন জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মী আবদুল লতিফ।

 

তিনি বলেন, ‘পেঁচার দ্বীপ সৈকতের ৪ কিলোমিটার এলাকা থেকে কাছিমের ডিম সংগ্রহ করা হয়। চলতি মৌসুমে প্রায় ২৭০০ কাছিমের ডিম সংগ্রহ করেছি। তারপর এগুলো কাছিম সংরক্ষণ ও প্রজনন কেন্দ্রে বালুচরে গর্ত করে রাখা হয়। এখন ৬০-৭০ দিন বা ৮০ দিনে বালুচরের গর্ত থেকে ডিমগুলো ফুটে কাছিমের বাচ্চা বের হয়ে আসছে। এরইমধ্যে ৮১৪টি কাছিমের বাচ্চা সাগরে অবমুক্ত করা হয়েছে। এই কাজ করতে খুবই আনন্দ লাগে।’

 

শুক্রবার সন্ধ্যায় সমুদ্রসৈকতের বালুচরে রাখা হচ্ছে সদ্য জন্ম নেয়া কাছিম ছানা। বালুচরে রাখতেই সব কাছিম ছানার গন্তব্য একই দিকে; ছুটে যাচ্ছে সমুদ্রের নোনাজলে। একের পর এক ঢেউয়ের বাঁধা ডিঙিয়ে সমুদ্রের নোনাজলের ছোঁয়া পেয়ে আনন্দে আত্মহারা ছানাগুলো।

 

চলতি মৌসুমে কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে মা কাছিমের মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি। গেলো ৩ মাসে মৃত্যু হয়েছে ১০৩টি মা কাছিমের। এর জন্য ট্রলিং জাহাজ ও জেলেদেরকে দায়ী করা হলেও কাছিম রক্ষায় স্বদিচ্ছার অভাব দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

 

নেকমের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন ম্যানেজার আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ‘কাছিম এখন হুমকির মুখে। একদিকে সাগরে ট্রলিং জাহাজের কারণে কাছিম মারা পড়ছে আর অন্যদিকে মা কাছিম যখন উপকূলে ডিম পাড়তে আসছে তখন জেলেদের জালে আটকা পড়ে মারা যাচ্ছে। এছাড়া কুকুরের কামড়েও কাছিমের মৃত্যু হচ্ছে। এক্ষেত্রে দিন দিন সামুদ্রিক কাছিম ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে।’

 

নেকমের ইকোলাইফ প্রকল্পের ডিপিডি ড. শফিকুর রহমান বলেন, ‘গত তিন বছরে ২৯ হাজার ৪৫০টি ডিম সংগ্রহ করে যা থেকে ৮৫ শতাংশ বাচ্চা ফুটিয়ে সাগরে অবমুক্ত করা হয়েছে। এ ধরনের পদ্ধতিকে এক্স-সিট্যু সংরক্ষণ বলা হয়। এছাড়া গত তিন বছরে ১০টি সংস্থান বা ইন-সিট্যু পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করে বাচ্চা সাগরে অবমুক্ত করা হয়। ইউএসএইড ও সামিটের অর্থায়নে এবং পরিবেশ ও বন অধিদফতরের দিক নির্দেশনায় নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট (নেকম) কাছিম সংরক্ষণের এ কাজ প্রায় ২০ বছর যাবত করে আসছে।’

 

‘সমুদ্রের ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার, আগাছা পরিষ্কার এবং মাছের পোনা খাদক জেলিফিশ খেয়ে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য বজায় রাখতে অনন্য ভূমিকা রাখে এ কাছিম। কক্সবাজার সৈকতের মাত্র ৩৪টি স্পটে সামুদ্রিক কাছিম ডিম পাড়তে আসছে যা, এক দশক আগেও ছিল ৫২টি। অর্থাৎ হুমকির মুখে সামুদ্রিক কাছিমের ডিম পাড়ার স্থানসমূহ। তাই পরিবেশ বন্ধু কাছিম সংরক্ষণে সরকারি-বেসরকারিভাবে সবাইকে এগিয়ে আসা প্রয়োজন বলে মনে করেন ড. শফিকুর রহমান।

 

এদিকে বনবিভাগ বলছে, কাছিমসহ সামুদ্রিক প্রাণী রক্ষায় সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করছে।

 

কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. সারওয়ার আলম বলেন, ‘কাছিম প্রকৃতির সুইপার। সমুদ্রের আবর্জনাগুলো ভক্ষণ করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা রাখে কচ্ছপ। কিন্তু আমাদের অসচেতনতায় নিজের আবাসস্থল হারাচ্ছে এ উপকারী প্রাণীটি। নিষিদ্ধ জালে মাছ শিকারকালে আটকা পড়ে মারা যায় কাছিম। পর্যটন বিকাশের কারণে কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূলে অতিরিক্ত আলোকায়নে কূলে ফিরে কুকুরের আক্রমণেও মরছে কাছিম।’

 

মো. সারওয়ার আলম বলেন, ‘কাছিমসহ সামুদ্রিক প্রাণী রক্ষায় সরকার নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। আশা করি, সামুদ্রিক কাছিমের জন্য উপকূলকে নিরাপদ করা হবে।’

 

চলতি মৌসুম কক্সবাজার সমুদ্র উপকূল থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক ৩০ হাজারের মতো কাছিমের ডিম সংরক্ষণ করা হয়েছে। এরইমধ্যে ৫ হাজার কাছিমের ছানা সাগরে অবমুক্ত করা হয়েছে।