নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাজধানীর মিরপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ-জার্মান কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সামনে ওএমএস-এর ট্রাক থেকে পণ্য বিক্রি হচ্ছিল। সেখানে লাইনে দাঁড়িয়ে চাল-আটা কিনছিলেন অনেকে। এই ট্রাকে সকাল ৯টায় শুরু হয় বেচাকেনা। তবে পণ্য কিনতে ভোরবেলা থেকেই লাইনে দাঁড়ান অনেকে। ট্রাকে প্রতি কেজি চাল বিক্রি হয় ৩০ টাকা দরে এবং প্রতি কেজি আটা পাওয়া যায় ২৪ টাকা কেজিতে। ৫ কেজি চালের দাম ১৫০ টাকা ও একই পরিমাণ আটার দাম ১২০ টাকা।
প্রত্যেকে পাঁচ কেজি চাল ও সমপরিমাণ আটা কিনতে পারেন। কিন্তু প্রতি ট্রাকে এক টন চাল আর দুই টন করে আটা বিক্রি হয়। যে কারণে লাইনে দাঁড়ানো মানুষের অর্ধেকেই চাল কিনতে পারেন না। তাদের শুধু আটা কিনে বাড়ি ফিরতে হয়।
দুপুরের আগেই শেষ হয়ে যায় চাল। পরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকাদের কাছে আটা বিক্রি করা হয়। যারা আটা কিনতে চান না তাদের খালি হাতে ফিরতে হয়। প্রতি সপ্তাহের রোববার ও সোমবার বাংলাদেশ-জার্মান কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সামনে ওএমএস’র ট্রাক নিয়ে আসেন বিক্রেতা সাগর। তিনি জানান, চালের বরাদ্দ কম থাকায় দুপুর ১টার মধ্যেই তা শেষ হয়ে যায়। এখন সব শ্রেণির মানুষ ওএমএস-এর পণ্য নিতে আসেন। আগে শুধু নিম্নআয়ের মানুষরা আসলেও এখন সব শ্রেণির লোকেরা ওএমএস- এর পণ্যের জন্য ভিড় করেন।
খাদ্য অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, বাজেট বরাদ্দ কম হওয়ায় চাহিদা থাকলেও বাড়তি পণ্য সরবরাহ দেয়া যাচ্ছে না।
৪ ঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন মো. হোসেন। মিরপুরের করলাপাড়া থেকে এসেছেন তিনি। বলেন, সকাল ১০টায় আসছি। ৪ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছি। মহিলারা ভোরে এসে সিরিয়াল দিয়ে ফুটপাথে বসে থাকেন। সকাল থেকে একশ’ থেকে দেড়শ’ লোকের সিরিয়াল থাকে। দোকান থেকে চাল কিনতে গেলে ৬০ টাকা লাগে। সেই চাল ৩০ টাকায় এখানে পাওয়া যাচ্ছে। এতক্ষণে এই চালও শেষ হয়ে গেছে। আটার জন্য এখনো দাঁড়িয়ে আছি। অভাবের কারণে এখানে আসতে হয় আমাদের। আমাদের মতো নিরীহ লোক একেবারে পথে বসে গেছে।
লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন শহীদুল্লাহ। কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি ১১টায় এসেছি। তারপরেও ৩০ থেকে ৪০ জনের পেছনে ছিলাম। আরও কিছু চালের বরাদ্দ বাড়ালে সবার জন্য ভালো হতো। ২৫ থেকে ৩০ জন একেবারে খালি হাতে যায়। চাল শেষ হয়ে গেছে। দেড়টা থেকে ২টার মধ্যে আটাও শেষ হয়ে যায়। আমরা যা পাই তাতে কয়েকদিনের খোরাক হয়।
করলাপাড়া বউ বাজার থেকে এসেছিলেন সেলিমা। তিনি বলেন, যারা ফজরের নামাজের পরে আসে তারা সবকিছু পায়। আমরা ৮টা/৯টা’র দিকে আসলে চাল পাই না। ফুরায় গেলে কীভাবে দেবে। মার্কেটে চাকরি করে তিনি ৫ হাজার ২শ’ টাকা বেতন পান জানিয়ে বলেন, বাসায় ৪ জন সদস্য। একমাত্র আমি আয় করি। মাসে একদিনও মাংস খাই না। অনেক কষ্টে সংসার চলে।
সকাল ৮টায় এসে ওএমএস-এর চালের জন্য দাঁড়িয়েছেন ফারহানা আক্তার। চাল না পেয়ে শুধু আটা নিয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন তিনি। বলেন, এখানে ৫ কেজি চাল দেড়শ’ টাকা দিয়ে নিতে পারি। বাহিরে কম হলেও এই চালের দাম আড়াইশ’ টাকা।
মিরপুরে অবস্থিত জনতা হাউজিং বস্তি থেকে এসেছিলেন রুমা আক্তার। তিনি বলেন, আসছি ১২টা বাজে। এতক্ষণ দাঁড়ায় আছি। তারপরেও চাল পাইলাম না। দেখি কাল আসলে যদি পাই।
দুপুর দেড়টায় এসেছিলেন শাকিল। দেরি হওয়ায় চাল-আটা কিছুই না পেয়ে খালি হাতে ফিরে যাচ্ছিলেন তিনি। একটি বাসার নিরাপত্তা কর্মীর কাজ করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, অফিস থেকে ছুটি নিয়ে এসেছি। চাল-আটা কোনোটাই না পেয়ে খালি হাতে ফিরে যাচ্ছি। ১৬ ঘণ্টা ডিউটি করে মাসে ৯ হাজার থেকে সাড়ে ৯ হাজার টাকা আসে। এ টাকায় এখন কীভাবে চলা যায়?
শাকিলের মতো খালি হাতে ফিরে যাচ্ছিলেন আবদুল হালিম। তিনি বলেন, আমার খুব আটার দরকার ছিল। বাসায় তিনজন মানুষ। দর্জির কাজ করি। এই কাজ করে মাত্র ১৫ হাজার টাকা মাসে আয় করি। এখান থেকেই চাল-আটা নেই। আজ কিছুই পেলাম না।
ফজরের নামাজ পড়ে অনেকেই এসে ওএমএস’র পণ্যের জন্য সিরিয়াল দেন জানিয়ে শিক্ষার্থী আবদুল আহাদ বলেন, ওইদিন ভোর ৪টায় ইস্তেমার জন্য যাচ্ছিলাম। দেখি মহিলারা সবাই ফুটপাথে বসে আছেন। যারা ভোরবেলা আসে তাদের সিরিয়াল পড়ে যায় ৫০ জনের পেছনে।
লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন জালাল উদ্দিন। তিনি বলেন, মানুষ অভাব অনটনে আছে। অনেকের ভাত নেই, মানুষের কাছে লজ্জার জন্য চাইতে পারে না। ১০টা’র সময়ে এসে দাঁড়াইছি। আবার নামাজ পড়ে এসে দাঁড়াইছি। অনেকে ফজরের আজানের পরে এসে সিরিয়াল দিয়ে বসে থাকে।
খাদ্য অধিদপ্তরের সরবরাহ, বণ্টন ও বিপণন বিভাগের পরিচালক মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, আমরা সবাই জানি, ওএমএস-এর পণ্যের অনেক চাহিদা। সকাল থেকে যে পরিমাণ লাইন লাগে, সবাই বলে বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ানো যায় কিনা। আমরাও জানি পণ্যের পরিমাণ বাড়ানো প্রয়োজন। চেষ্টা করছি কীভাবে বাড়ানো যায়। আগামী অর্থবছরে বাজেট পেলে আমরা পণ্যের পরিমাণ বাড়ানোর চেষ্টা করবো।