চট্টগ্রাম অফিস:
চট্টগ্রাম: ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট। ঠেলাঠেলি, ছিনতাই, গায়ে পড়ে ঝগড়া ছিল নিত্যচিত্র। হাঁটার জো ছিল না ফুটপাতে। শুধু কি ফুটপাত, সড়কের অর্ধেকও দখলে ছিল হকারদের। নকল, কমদামি ঘড়ি, জামা বা গৃহস্থালি পণ্যের দাম জানতে চাইলেও ওঁৎপেতে ছিল বিপদ। কিনতে না চাইলে সংঘবদ্ধ চক্র এসে জোর করে গছিয়ে দিত।
এটি কোতোয়ালী থানাধীন জুবিলি রোডের আমতল থেকে নিউমার্কেট মোড়, পুরাতন স্টেশন থেকে নিউমার্কেট মোড়, কোতোয়ালী মোড় থেকে জিপিও পর্যন্ত চিরচেনা দৃশ্য ছিল বুধবার (৭ ফেব্রুয়ারি) রাত পর্যন্ত।
বৃহস্পতির (৮ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকে চিরচেনা দৃশ্য বদলে যেতে থাকে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) ফুটপাত ও সড়কের হকার এবং অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান শুরুর পর বেলা ১১টার মধ্যে পুরো এক বর্গকিলোমিটার এলাকার ফুটপাত, সড়ক সাফ হয়ে যায়। সাত জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে শত শত পুলিশ, র্যাব সদস্য, চসিকের স্ট্রাইকিং ফোর্স, নিরাপত্তা কর্মী আর শ্রমিক দায়িত্ব পালন করেন উচ্ছেদ অভিযানে। ছিল শক্তিশালী বুলডোজার, স্ক্যাভেটার, ট্রাকও। হকাররা পড়িমরি করে নিজেদের পসরা সাজানোর খাট, চৌকি, বাঁশ, টেবিল এমনকি সেমিপাকা স্থাপনাও সরিয়ে নিতে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে কাঁটাতারের বেড়া ও সতর্কীকরণ নোটিশ দিয়ে দেন চসিকের কর্মীরা। অন্যান্য সময় উচ্ছেদ অভিযানে হকাররা বাধা দিতেন, এবার চসিকের অনঢ় অবস্থানের কারণেই হয়তো সেই দৃশ্য দেখা যায়নি। তবে উচ্ছেদের পরে একটি বিক্ষোভ মিছিল করতে দেখা গেছে।
গত ৩০ জানুয়ারি চসিকের মাসিক সভায় ফুটপাত হকারমুক্ত করতে ব্যাপক অভিযান চালানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। বৃহস্পতিবার অভিযান শেষে মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, নিউমার্কেট মোড়ের হকার উচ্ছেদ একশ্রেণির চাঁদাবাজদের কারণে খুবই কঠিন। এ চাঁদাবাজদের কারণে মানুষ স্বস্তিতে হাঁটতে পারত না, সড়কে জ্যাম লেগে থাকত। আমি সাহস করে এবং নিজের ওপর ঝুঁকি নিয়ে চট্টগ্রামের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেছি। উদ্ধার হওয়া জায়গা রক্ষায় কাঁটাতারের বেড়াও দিয়েছি। পাশাপাশি উদ্ধার হওয়া জায়গায় নিয়মিত মনিটরিং চলবে। কোনো হুমকি, ধামকি বা প্রলোভনে কাজ হবে না। যে জনগণ আমাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে তাদের স্বার্থে কাজ করে যাব।
অভিযান চলাকালেই কথা হয় পূর্ব মাদারবাড়ীর বাসিন্দা সত্তরোর্ধ্ব আবদুল হাইয়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, আজ অচেনা লাগছে নিউমার্কেট এলাকা। প্রথমে ভেবেছিলাম স্বপ্ন দেখছি। পুরো ফুটপাত ফকফকা। দেখেই মন ভরে যাচ্ছে। এখানে কত মানুষ নাজেহাল হয়েছে, কত মা-বোন লাঞ্ছিত হয়েছে তার হিসাব নেই। হকারদের কাছে সবাই জিম্মি ছিলেন। আজ প্রমাণ হলো সরকার বা প্রশাসন চাইলে সব
নিউমার্কেট মোড়ে টাইগারপাস এলাকা থেকে টেম্পু নিয়ে আসা চালক স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, স্টেশন রোডের ফুটপাত ঘেঁষে কখনোই গাড়ি দাঁড় করাতে পারতাম না। হকারদের দখলে থাকতো সড়কের বড় অংশ। আজ প্রথমবারের মতো সড়কের একপাশে গাড়ি থামাতে পারলাম। দিন বদলে গেছে ভাই।
স্কুলছাত্রী আনিকা মুক্তাও খুশি উচ্ছেদ অভিযানের কারণে। বললো, প্রতিদিন স্কুলে আসার সময় রিকশা আসতে চাইতো না। সড়কের অর্ধেক হকারদের দখলে থাকতো। হেঁটে যে কিছুটা পথ আগাবো সেই পরিবেশ ছিল না। এখন কত বড় সড়ক দেখা যাচ্ছে। যানজট আর থাকবে না।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহ-সভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া সিএনএন বাংলা২৪কে বলেন, ফুটপাত হাঁটার জন্য। যেহেতু এত দিন হকাররা সেখানেই রুটি রুজির সংস্থান করে আসছিল তাই তাদের পুনর্বাসন বা বিকল্প কোনো মাঠে বা খোলা জায়গায় নির্দিষ্ট সময় বসার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ ফুটপাতে অফিসফেরত লোকজন কেনাকাটা করতো বলেই জমজমাট ছিল। আমি কলকাতার সল্ট লেকে দেখেছিলাম বিশাল মাঠে সকালে কাঁচাবাজার বসে। এরপর পরিষ্কার করা হয়। আবার সেই মাঠে বিকালে শিশুরা খেলাধুলা করে, বৃদ্ধরা হাঁটাহাঁটি করে। চট্টগ্রামেও সুপরিকল্পিতভাবে হকারদের জন্য নাইট মার্কেট, হলিডে মার্কেট, নির্দিষ্ট সময় কোনো মাঠে বেচাকেনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
স্থপতি আশিক ইমরান সিএনএন বাংলা২৪কে বলেন, ফুটপাতে মানুষ হাঁটবে, সড়কে গাড়ি চলবে। হকারদের ফুটপাতে ব্যবসার সুযোগ দেওয়া সমাধান নয়। ঢাকায় হলিডে মার্কেট সাকসেসফুলি রান করছে। ফ্লাইওভারের নিচে অনেক জায়গা আছে, প্রতিটি ওয়ার্ডে কিছু কিছু খোলা জায়গা বা মাঠ আছে, অনেক প্রশস্ত সড়ক আছে যার কিছু অংশ অব্যবহৃত থাকে এরকম জায়গাগুলো মাল্টিফাংশনাল করা যেতে পারে। এর জন্য অবশ্যই বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসতে হবে সিটি করপোরেশনকে।
চট্টগ্রাম ফুটপাত হকার সমিতির সভাপতি নুরুল আলম লেদু সিএনএন বাংলা২৪কে বলেন, নোটিশ ছাড়াই আজ অতর্কিত উচ্ছেদ করা হয়েছে। নির্বাচনের আগে মেয়র বলেছিলেন, পুনর্বাসন না করে কোনো হকার উচ্ছেদ করা হবে না। বিগত দিনে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন, প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন ও সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী আমাদের শৃঙ্খলার সঙ্গে ফুটপাতে বসে ব্যবসা করতে দিয়েছিলেন। এখন হঠাৎ করে এতগুলো মানুষের পরিবারের রুটি-রুজি ও তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার কী হবে! আমরা তো চুরি-ডাকাতি করি না, ব্যবসা করে খাই। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই। অবিলম্বে বিকল্প ব্যবস্থাসহ স্থায়ী পুনর্বাসন চাই।