ই-পেপার | বৃহস্পতিবার , ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সয়েল টেস্ট কেন প্রয়োজন

ড. মো. নূরুল হুদা আল মামুন

 

মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যেমন খাবার প্রয়োজন, তেমনি সব গাছেরও খাবারের প্রয়োজন হয়। আমরা জানি, যে কোনো ফসলের জীবনচক্রে (বীজ থেকে বীজ) উদ্ভিদের যেসব খাদ্যোপাদানের দরকার হয়, তার মধ্যে ১৭টি খাদ্যোপাদান অত্যন্ত জরুরি, যদিও ১৭টি খাদ্যোপাদানের বাইরে আরো অনেক উপাদান আছে। তবে সেগুলো বিশেষভাবে জরুরি নয়। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের মোট কৃষিজমির শতকরা ৭৫ ভাগ তার উর্বরতা হারিয়েছে। একজন কৃষক বহু বছর ধরে একটার পর একটা ফসল চাষ করছেন, ফলে জমি বিশ্রাম পাচ্ছে না। প্রতিটি চাষের সময় নানা রকমের রাসায়নিক সারের ব্যবহার করছেন। বেশির ভাগ কৃষক জৈবসার ব্যবহার কম করে থাকেন, ফলে মাটির চরিত্র বদলে যাচ্ছে। কৃষক অধিক মুনাফার জন্য প্রয়োজনের তুলনায় বেশি মাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করছেন। সুষম ও পরিমিত মাত্রায় সার ব্যবহার করছেন না। ফলে দিনের পর দিন এভাবে চলার ফলে জমির উর্বরাশক্তি কমে যাচ্ছে, ফলে ফলন কম হচ্ছে।

 

‘বাংলাদেশে বৈচিত্র্যময় ফসলের জন্য পুষ্টি ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক প্রকল্পের দলনেতা ও অস্ট্রেলিয়ার মারডক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক রিচার্ড ডব্লিউ বেল-এর গবেষণা মতে, ‘কৃষক যদি সারের পরিমিত ব্যবহার নিশ্চিত করে, তাহলে বছরে ৭৫ লাখ টনের বেশি ধানের উত্পাদন বৃদ্ধি পাবে। মোট বার্ষিক লাভ হবে ২০ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা।’ এর জন্য দরকার নিয়মিত সয়েল টেস্ট বা কৃষিজমির মাটি পরীক্ষা করা। মাটি পরীক্ষা করলে জানা যাবে কী কী খাদ্যোপাদান কী পরিমাণে আছে। কী পরিমাণে বাড়তি সার বা খাদ্য উপাদান দিতে হবে। এমনো দেখা যায়, বছরের পর বছর অনুমানভিত্তিক নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম সার জমিতে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু মাটি পরীক্ষার পর দেখা গেল ফসফেটের মাত্রা অতি উচ্চ, পটাশের মাত্রাও অনেক বেশি, আবার অন্যান্য খাদ্যোপাদানের মাত্রা বেশ কম রয়েছে। কৃষক ফসল অনুযায়ী তার প্রয়োজনীয় মাত্রায় সারের ব্যবহার করেছেন, মাটি পরীক্ষার পর জানা যায় বেশ কিছু সারের অপব্যবহার হয়েছে। তাই প্রত্যেকটি জমির মাটি বছরে অন্তত এক বার পরীক্ষা করতে হবে। সম্ভব না হলে কমপক্ষে তিন বছর থেকে চার বছর পরপর মাটি পরীক্ষা করা উচিত।

 

বেশি মাত্রায় রাসায়নিক সারের ব্যবহারে মাটিতে বসবাসকারী উপকারী জীবাণুর সংখ্যাও কমতে থাকে, ফলে ফসলের ফলন কমে যায় এবং মাটি মৃত হয়ে যায়, যেমন মরুভূমির মাটিকে মৃত মাটি ধরা হয়। মাটি পরীক্ষা করে মাটির স্বাস্থ্য জানার পর সুষম সার ব্যবহার করলে শুধু যে অর্থের সাশ্রয় হবে, তা নয়, মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকবে এবং পরিবেশও ভালো থাকবে। এছাড়া মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে কৃষি ফসলের উত্পাদন খরচ শতকরা ১৫-২৫ ভাগ কমিয়ে আনা সম্ভব। এসব কারণে মাটি পরীক্ষা করা ছাড়া কোনো বিকল্প উপায় নেই।

 

মাটির স্বাস্থ্যকে সঠিকভাবে জানতে হলে মাটি সংগ্রহের বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি জানতে হবে। একটি জমির ফসল তোলার পর এবং পরবর্তী ফসল ফলানোর আগে মাটির নমুনা নিতে হবে। প্রথমে জমিতে মোটামুটি সমান দূরত্বে ০৯টি স্থান নির্বাচন করতে হবে। জমির আইল থেকে কম করে দুই হাত ছেড়ে স্থান নির্বাচন করতে হবে। এ ব্যাপারে আমরা স্থানীয় সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি। পরীক্ষার জন্য মাটিতে বিদ্যমান পাথর, নুড়ি, কাঁকর, ঘাস, লতা-পাতা ফেলে মাটি পরিষ্কার করে নিতে হবে। ২০০-৩০০ গ্রাম পরিমাণ মাটির নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য রাখতে হবে। সংগ্রহ করা মাটিতে যদি বেশি আর্দ্রতা থাকে, তাহলে ছায়াযুক্ত স্থানে খবরের কাগজের ওপর রেখে দুই থেকে তিন দিন রেখে শুকাতে হবে। প্রধানত মাটির অম্ল/ ক্ষারের পরিমাণ, লবণের পরিমাণ, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সালফার, বোরন ইত্যাদি পরীক্ষা করা হয়। অনুখাদ্যের পরিমাণ জানতে হলে আধুনিক স্থায়ী পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা যেতে পারে।

 

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে দুই ধরনের গবেষণাগারে মাটি পরীক্ষা করা যায়। প্রথমত স্থায়ী গবেষণাগার এবং দ্বিতীয়ত ভ্রাম্যমাণ মৃত্তিকা গবেষণাগারের মাধ্যমে মাটি পরীক্ষা করে সার সুপারিশ কার্ড দেওয়া হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের সাতটি বিভাগীয় গবেষণাগার, ১৬টি আঞ্চলিক গবেষণাগার রয়েছে। বিভাগীয় এসব গবেষণাগারগুলো ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট এবং বরিশাল অবস্থিত। আঞ্চলিক গবেষণাগারগুলো কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, জামালপুর, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, কিশোরগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া, দিনাজপুর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, যশোর, নোয়াখালী, রাঙ্গামাটি এবং পটুয়াখালী জেলায় অবস্থিত। এসব স্থায়ী গবেষণাগারের মাধ্যমে বছরের যে কোনো সময়ে ৬৩/-টাকার বিনিময়ে মাটির প্রায় সব উপাদান পরীক্ষা করা যায়। এছাড়াও বর্তমানে ১০টি ভ্রাম্যমাণ মাটি পরীক্ষা গবেষণাগার (MSTL) রয়েছে, যেখানে মাত্র ২৫/-টাকার বিনিময়ে মাটি পরীক্ষার সুযোগ রয়েছে।

 

পরিশেষে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের মাধ্যমে অধিক ফসল উত্পাদন করে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। নিজেদের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমাদের খাদ্যের উত্পাদন বাড়ানোর বিকল্প নেই। এজন্য মৃত্তিকা পরীক্ষা গবেষণাগারের মাধ্যমে মাটি পরীক্ষা করে সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করে মাটির স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে হবে।

লেখক: প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, কৃষি মন্ত্রণালয়, আঞ্চলিক গবেষণাগার, ফরিদপুর