ঈদগাঁও প্রতিনিধি।
কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে বাঁকখালী নদী। নদীটির এক পাশে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা অপর পাশে কক্সবাজারের রামু-সদর উপজেলা। এইতো আশির দশকেও এই নদীতে বারো মাস পানির প্রবল স্রোত বইতো। কিন্তু বর্তমানে এ অঞ্চলের অন্যান্য নদীর মতই বাঁকখালী নদীও শুষ্ক মৌসুমে যৌবন হারিয়ে মৃতপ্রায়। বোরো মৌসুম এলে বাঁকখালী যৌবন হারানোর প্রভাব পড়ে নদীর আশপাশের এলাকাগুলোতেও। নদীর দুই পাশের বিস্তীর্ণ এলাকায় ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যায়।
শুষ্ক মৌসুমে ১৫ হাজার হেক্টর জমির চাষাবাদ নির্ভর করে বাঁকখালী নদীর রাবার ড্যামের পানি সেচ ব্যবস্থাপনার উপর। বেশ কয়েক বছর যাবত বাঁকখালী নদীর উপর নির্মিত রাবার ড্যামটি অকেজো হয়ে পড়ে আছে। একারণে কৃষকদের মাঝে পানি সরবরাহের লক্ষ্যে ১ টি অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ।
কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এই বাঁধ নির্মাণকে কেন্দ্র করে সরকারি কোটি কোটি টাকা লোটপাটে মেতে উঠেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) কথিপয় অসাধু কর্মকর্তা ও তাদের পোষা ঠিকাদার।
দীর্ঘ ৫ বছর যাবত যথা সময়ে বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়ায় প্রতি বছর চরম হতাশায় পড়েন জেলার অন্তত ২০ হাজার কৃষক। তাদের দাবী, সরকারি টাকা লুটপাট করার জন্য নামে মাত্র বাঁধ নির্মাণ করা হয়। অসময়ে বাঁধ নির্মাণ করে বিপুল টাকা আত্মসাৎ করেছিল এলজিইডি অফিসের ফারুক ও তার কর্তাবাবুরা।
এ কারণে অধিকাংশ জমিই পড়ে থাকতো অনাবাদি হয়ে। তবে এই বছর এলাকার কৃষকের মুখে হাসি ফোঁটায় সাইফুদ্দিন নামের এক ঠিকাদার। তিনি মাত্র ২৩ দিনে ১ কোটি ২৮ লাখ টাকার একটি বাঁধ নির্মাণ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।
ঠিকাদার সাইফুদ্দিন বলেন, ডিসেম্বরের ১৮ তারিখ প্রকল্পটি টেন্ডারের মাধ্যমে আমি পেয়ে ২২ তারিখ বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করে ১৭ জানুয়ারি সেটি শেষ করি। এতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কারণে শ্রমিক সংকট হয়। একারণে ২৩ দিন সময় লেগেছে। অন্যথায় ১০ থেকে ১২ দিনে কাজটি শেষ হয়ে যেতো দাবি করেন তিনি।
ঝিলংজার চান্দের পাড়ার মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া বাঁকখালী নদীতে শুষ্ক মৌসুমে পানি ধরে রাখতে রাবার ড্যামের পরির্বতে ১১০ মিটারের একটি অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হয়।। এই দ্রুত সময়ে বাঁধ নির্মাণের পর থেকেই হাসি ফোঁটে রামু সদরের প্রায় ২০ হাজার কৃষকের মুখে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বাঁকখালী নদীর উপর নির্মিত বাঁধটি নদীর বুকে ধরে রাখেছে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি। আর যে পানি দিয়ে চলতি শুষ্ক মৌসুমে রামু উপজেলায় গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া, কাউয়ারখোপ, ফঁতেখারকুল, দক্ষিণ মিঠাছড়ি, চাকমারকুল, ও সদর উপজেলার ঝিলংজা, পিএমখালীসহ বাঁকখালীর দুপাশের প্রায় ৫০ টি গ্রামের বিশাল এলাকা জুড়ে জমিতে চাষাবাদ করছেন কৃষকরা।
পানি সংকট না থাকায় শুকনো মৌসুমে ধান এবং সবজি উৎপাদন করে দ্বিগুণ লাভবান হবেন বলে আশা করছেন কৃষকরা। জমিতে সময়মতো পানি সরবরাহ করতে পারায় ধানক্ষেত সবুজে সবুজে ভরে যাবে বলে মনে করছেন তারা।
ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেছে, ষাটের দশকে শুষ্ক মৌসুমেও বাঁকখালী নদীতে ব্যাপকভাবে পানি প্রবাহিত হতো। আর এ নদীর পানি দিয়ে সেচের মাধ্যমে কৃষিকাজে ব্যবহার করে এলাকার কৃষকরা নানা রকম ফসল উৎপাদন করত। এছাড়া নদীতে পানির পর্যাপ্ত প্রবাহ অব্যাহত থাকায় প্রচুর পরিমাণে মাছ উৎপাদন হতো। তাই সারা বছর স্থানীয় মৎস্যজীবী পরিবারগুলো নদী থেকে মাছ ধরে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন। কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে নানা কারনে মৃতপ্রায় বাঁকখালী নদী। শুষ্ক মৌসুমে প্রায় পানিশূন্য থাকায় নদীতে মাছের উৎপাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। নদীর পানি ব্যবহার করে কৃষিকাজও করতে পারছেন না এ অঞ্চলের কৃষকরা। সেচের পানির অভাবে এলাকার অধিকাংশ জমি পড়ে থাকে অনাবাদি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়- ১৯৯৫ সালে স্থানীয় কৃষকদের ব্যাপক চাহিদার ভিত্তিতে ঝিলংজা ইউনিয়নের চান্দের পাড়া এবং পিএমখালী ইউনিয়নের ঘাটকুলিয়াপাড়া অংশে নির্মিত রাবার ড্যামটি প্রায় ৫ বছর ধরে অকেঁজো হয়ে পড়েছে। ফলে কয়েক বছর যাবত পানি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। বিগত ৫ বছর যাবত বাঁকখালী নদীর উপর অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করে সরকার কৃষকদের চাহিদা পুরণের চেষ্টা করলেও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার আর ঠিকাদারের কারণে সেই বাঁধ কোন কাজেই আসেনি। তবে এবার তার ব্যাতিক্রম হয়েছে।
কক্সবাজার সদর উপজেলা প্রকৌশল অফিসের সহকারী প্রকৌশলী হেলাল উদ্দিন বলেন, নদীতে পানি না থাকলে এর আশপাশের এলাকার ভূ-গর্ভের পানির স্তরও কমে যায়। বর্তমানে বাঁকখালী নদীর উপর পানি থাকায় নদীর আশপাশের এলাকায় ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর উপরে উঠে এসেছে। আর এই কারণে বাঁকখালী নদীর দুপাশের জমি গুলোতে দ্বিগুণ ফলন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।