শিব্বির আহমদ রানা, বাঁশখালী :
এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও দলীয় মনোনয়ন নিয়ে তিনি এমপি নির্বাচিত হন। এ আসনে আরো দুই স্বতন্ত্র হেভিওয়েট প্রার্থী- চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মুজিবুর রহমান সিআইপি ঈগল প্রতীক নিয়ে ও ট্রাক প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আবদুল্লাহ কবির লিটন অংশ নেওয়ায় নির্বাচনের মাঠে জোরালো প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি রয়েছেন এ তিন প্রার্থী। তারা তিনজনই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত। বাঁশখালীর আওয়ামী রাজনীতিতে তাদের তিনজনেরই নিজস্ব বলয় রয়েছে। এবারের নির্বাচনে তাদের তিনজনের মধ্যে ত্রিমুখী লড়াইয়ের আভাস দেখা যাচ্ছে। প্রার্থীদের প্রচার প্রচারণায় এখনো পর্যন্ত বাঁশখালীতে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে।
একদশক ধরে লাগাতার দুই বারের সংসদ সদস্য ছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। এরই মধ্যে বহুবার আলোচনা-সমালোচনায় আসেন এ সাংসদ। খোদ্ তার সময়ে আ’লীগের মধ্যে ঐক্যের চেয়ে ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে বেশী এমনটি ধারণা করেন প্রবীন অনেক আ’লীগ নেতারা। যার দরুণ বাঁশখালীতে নৌকা ছেড়ে আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা-কর্মী, স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানরা ঈগল এবং ট্রাক প্রতীকের প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন প্রকাশ্যে। তাদের সুস্পষ্ট অবস্থান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও বার্তা এবং স্ট্যাটাসের মাধ্যমে জানিয়ে দিচ্ছেন। এ নিয়ে এলাকায় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। তাছাড়া নানান ঘটনার জন্ম দিয়ে বর্তমানে কিছুটা অস্বস্তিতে পড়েছেন নৌকা প্রার্থী মোস্তাফিজ। অপরদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মুজিবুর রহমান সিআইপি (ঈগল প্রতীক) এবং দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আব্দুল্লাহ কবির লিটন (ট্রাক প্রতীক) নিজ নিজ অবস্থানকে শক্ত মনে করছেন। অনেকে বলে বেড়াচ্ছেন বাঁশখালীর অভিভাবক হিসেবে নৌকা ছাড়া ঈগল ও ট্রাকের যে কেউ আসুক। বিগত দুই বারের মতো সাংসদ থেকে মোস্তাফিজের আমলে বাঁশখালীতে যে পরিবর্তন হওয়ার কথা তেমন উন্নয়ন চোখে পড়েনি এমন অভিযোগের তীর তার দিকে। অভ্যন্তরিণ সড়কসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নে পিছিয়ে রয়েছে বাঁশখালী। এই তিন প্রার্থী ছাড়া আরও ৭ জন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তারা হলেন- স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. খালেকুজ্জামান (বেঞ্চ), ছনুয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জিল্লুর করিম শরীফি (কংগ্রেস পার্টি থেকে ডাব), ন্যাপের প্রার্থী আশীষ কুমার শীল (কুঁড়েঘর), বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের মহিউল আলম চৌধুরী (মোমবাতি), ইসলামী ঐক্যজোটের শফকত হোসেন চাটগামী (মিনার), ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের আবদুল মালেক আশরাফী (চেয়ার), এনপিপির মামুন আবছার চৌধুরী (আম)।
এদিকে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি মুজিবুর রহমান ঈগল প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। বিগত সময়ে তিনি বাঁশখালীর রাজনৈতিক মাঠে সক্রিয় না থাকলেও তার পক্ষে উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র কয়েকজন নেতা, সাবেক ও বর্তমান জনপ্রতিনিধিরা মাঠে নেমেছেন। প্রার্থী নিজেও বাঁশখালীর গ্রাম গঞ্জে চষে বেড়াচ্ছেন। প্রচার প্রচারণায় এখন পর্যন্ত অন্য প্রার্থীদের চেয়ে তিনি এগিয়ে রয়েছেন। শিক্ষা, আর্থসামাজিক উন্নয়নে, করোনাকালীন সময়ে তিনি বাঁশখালী জুড়ে মানবতার উদার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। সর্বসাধরণের কাছে ইতোমধ্যে তিনি বেশজনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। ভোটের মাঠে আপাতত সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও মাঠে তার শক্ত প্রতিপক্ষও রয়েছে। ভোটের মাঠে নতুন প্রার্থী হওয়ায় প্রতিপক্ষকে তিনি কতটুকু মোকাবিলা করতে পারবেন তা নিয়েও ভোটারদের মাঝে নানা আলোচনা রয়েছে। তবে নির্বাচনী সভা, সমাবেশে পরিকল্পিত উন্নয়নের কথা বলায় সাধারণ এবং নতুন ভোটাররা তার দিকে ঝুঁকছেন।
অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আবদুল্লাহ কবির লিটন। তিনি ৩২ বছর ধরে বাঁশখালীর আওয়ামী রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে একটি পক্ষের নেতৃত্ব দিয়ে আসলেও এবারই প্রথম ভোটের মাঠে লড়েছেন। তিনিও নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে প্রতিদিনই প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি ট্রাক প্রতীকে নির্বাচন করছেন। তিনি নির্বাচনী মাঠে আসার পর কয়েকজন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিও তার পক্ষে মাঠে নেমেছেন। দিন যতই ঘনিয়ে আসছে তার জনপ্রিয়তা বাড়ছে বহুগুণ। আবদুল্লাহ কবির লিটন আওয়ামী লীগের প্রয়াত প্রেসিডিয়াম সদস্য আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ও ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের নিকটাত্মীয়। বাঁশখালী আসনে আবদুল্লাহ কবির লিটনকে বিজয়ী করতে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ কাজ করছেন বলেও গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। বাঁশখালীর সাবেক সাংসদ, মুক্তিযোদ্ধা সোলতান-উল কবির পুত্র উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান (প্রাক্তন) চৌধুরী মোহাম্মদ গালীব সাদলীও লিটনের পক্ষে প্রচার প্রচারণায় একাট্টা হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।
বাঁশখালী আসনে এবারে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী, স্বতন্ত্র প্রার্থী মুজিবুর রহমান ও আবদুল্লাহ কবির লিটনের মধ্যে ত্রিমুখী লড়াই হবে বলে মনে করেন সাধারণ মানুষ। ভোটের মাঠে অনেকেই মনে করেন এবার দুই স্বতন্ত্র্য প্রার্থীর শক্ত অবস্থানে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মোস্তাফিজ রয়েছেন বিপাকে। সাধারণ ভোটারদের প্রত্যাশা, তারা যেন সংঘাত ছাড়া নির্বিঘ্নে, উৎসবমুখর পরিবেশে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে এবং যাকে ভোট দিবেন তিনিই যেন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার এস.এম.শফিউল্লাহ বিপিএম নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে সাংবাদিকদের সাথে ব্রিফিংকালে বলেন, ‘কোনো রকম সংঘাত ছাড়াই, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে বাঁশখালী উপজেলা প্রশাসন পক্ষপাতহীন পেশাদারিত্ব বজায় রেখে কাজ করবে। ভোটাররা নির্ভিঘ্নে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারবে। নির্বাচনে কেউ নাশকতার চেষ্টা করলে ছাড় দেওয়া হবে না। আর যারা অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী, বিতর্কিত ব্যক্তি তাদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত আছে। আমরা অভিযানকে আরো জোরদার করবো। আমরা তাদের অনুরুধ করবো, বিগত দিনের পথ থেকে সরে যান, আপনারা আগের মতো সুযোগ আর পাবেন না।’
উল্লেখ্য, এবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে ৩ লাখ ৭০ হাজার ৭৭৫ জন ভোটার ১১৪টি কেন্দ্রে ৭৬৩টি বুথে ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। বাঁশখালীর নৌকা প্রার্থী এমপি মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে গত ২৬ ডিসেম্বর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. হারুণ মোল্লা বাদি হয়ে আচরণবিধি লঙ্ঘন ও সাংবাদিকদের পেটার অপরাধে মামলা দায়ের করেছেন। বাঁশখালী থানার ওসি তোফায়েল আহমদকে মোবাইলে হুমকি দেয়ার অপরাধে বাঁশখালী থানায় ২২ ডিসেম্বর এমপি’র বিরুদ্ধে করা জিডির তদন্ত চলছে। নির্বাচনের আগে মুক্তিযোদ্ধাকে পেটানো, প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শনসহ নানান ঘটনা ঘটানোর কারণে তিনি আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন।