সিএনএন বাংলা২৪,রাজবাড়ী
ক্ষতিকর দিক বিবেচনায় তৃণমূলের কৃষকরা রাসায়নিক সারের পরিবর্তে ভার্মি কম্পোস্টের (কেঁচো সার) দিকে ঝুঁকছেন রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার কৃষকরা। কৃষি অফিসের সহযোগিতায় বাণিজ্যিকভাবে এই কেঁচো সার উৎপাদন করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন উপজেলার ছোট ভাকলা ইউনিয়নের স্বরূপার চক গ্রামের অর্ধশতাধিক নারী। ফলে দিন দিন বাড়ছে এ সারের চাহিদা।
সরেজমিন গোয়ালন্দ উপজেলার ছোট ভাকলা ইউনিয়নের স্বরূপার চক গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের অর্ধশতাধিক নারী নিজেদের প্রচেষ্টায় বাড়িতে গড়ে তুলেছেন ভার্মি কম্পোস্ট (কেঁচো সার) তৈরির হাউজ। ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন ও বিপণনে তাদের সংসারে এসেছে স্বচ্ছলতা। এক সময়ের নিত্য অভাবকে জয় করে এখন তারা নিজেরাই স্বাবলম্বী। সমাজ তথা পরিবারেও তাদের মাথা উঁচু করে দিয়েছে এই কর্মযজ্ঞ।
উদ্যোক্তা মোছা. জোসনা আক্তার বলেন, এক সময় আমার সংসারে অভাব ছিল। ওই অবস্থায় উপজেলা কৃষি অফিসের সহযোগিতায় আমার আশেপাশের কয়েকজন নারীদের নিয়ে সমবায় সমিতি গঠন করে প্রথমে তিনটি রিং-এ থাই কেঁচোর দ্বারা ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদন শুরু করি। সেই সার দিয়ে আমি ও আশেপাশের নারীরা পরিত্যক্ত জমিতে সবজি চাষ করি। সেই বিষমুক্ত সবজি নিজেদের চাহিদা পূরণের পর বাজারে বিক্রি করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছি।
তিনি বলেন, প্রথমে কৃষি অফিসের সহায়তায় ৫টি রিংয়ে বাণিজ্যিকভাবে কেঁচো সার উৎপাদন করেছি, পরে আমি সার বিক্রি করে আরও রিং বাড়িয়েছি। বর্তমানে আমার এখানে ২০টি রিং রয়েছে। আমাদের উৎপাদিত ভার্মি কম্পোস্টের সুনাম আশেপাশের এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়েছে। নিজেদের চাহিদা পূরণ করে প্রতি মাসে এই কম্পোস্ট সার বিক্রি করে ৭-১০ টাকা হাজার পর্যন্ত আয় হচ্ছে তার। এছাড়া দূর-দূরান্তের কৃষকরা এ সার ব্যবহার করে উপকৃত হচ্ছেন।
আরেক উদ্যোক্তা খোদেজা বেগম বলেন, এক সময় দু’টি টাকার জন্য স্বামীর কাছে ধন্না দিতে হত। ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদন করে আমি এখন স্বাবলম্বী। আমি এখন সংসারেও নিজের উপার্জিত টাকা খরচ করে সম্মানিত বোধ করি। সেই সঙ্গে ছেলে-মেয়েদের বিভিন্ন প্রয়োজনে তাদেরও টাকা দিতে পারি।
উপজেলা কৃষি অফিসের পরামর্শে কৃষি উন্নয়ন বহুমূখী সমবায় সমিতির মাধ্যমে ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদন করে খোদেজা বেগমের মত ওই গ্রামের অর্ধশত নারী এখন স্বাবলম্বী। এ গ্রামের নারীদের উৎপাদিত ভার্মি কমপোস্ট সার বিক্রিতেও কোনো ঝামেলায় পড়তে হয় না। কারণ শুধু গোয়ালন্দ না, রাজবাড়ী জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে এসে তাদের উৎপাদিত টন টন সার বাড়ি থেকেই ১২ থেকে ১৫ টাকা কেজি দরে কিনে নিয়ে যায়। এই গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ দীর্ঘদিন ধরে কৃষির উপর নির্ভরশীল। তবে গ্রামটির বিশেষত্ব হচ্ছে পুরুষরা মাঠে কাজ করলেও গৃহিণীরা বাড়িতে গবাদি পশু পালন এবং গোবর থেকে ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদন করছেন। এই গ্রামের নারীরা কোনোভাবেই পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে নেই।
পৌরসভা ৩নং ওয়ার্ড জবানী রায়ের পাড়া এলাকার অপর নারী উদ্যোক্তা জেসমিন আক্তার জানান, অনেক আগে থেকেই তার মধ্যে নিজে কিছু করার প্রয়াস ছিল। এ লক্ষ্যে তিনি বাড়িতে গরু-ছাগল পালনের চেষ্টা করে আসছিলেন। এরই মধ্যে উপজেলা কৃষি অফিসের সহযোগিতায় প্রথমে আমার বাড়ির ছাদে ৬ রিং এ ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদন শুরু করি। এতে তিনি বেশ লাভবান। কারণ এক সময় গরুর গোবর ফেলে দেওয়া হত। সেই ফেলে দেওয়া জিনিসই এখন অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শুধু তিনি নন, এই গ্রামের প্রত্যেকটি বাড়িতে রয়েছে এই সার তৈরির কারখানা, যেগুলোর মূল উদ্যোক্তা গৃহবধূরা। এছাড়া তাদের দেখাদেখি এখন অন্য গ্রামের গৃহবধূরা এই সার তৈরিতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
কৃষি উন্নয়ন বহুমূখী সমবায় সমিতির সাধারন সম্পাদক বিউটি আক্তার জানান, গ্রামের গৃহবধূদের তাদের সমিতির মাধ্যমে কেঁচো সার তৈরির ধারণাদেন স্থানীয় কৃষি অফিস। তারাই প্রশিক্ষণ ও কেঁচো সরবরাহ করেছিলেন। বর্তমানে তাদের সমিতির অন্তত ৫২ জন্য সদস্য নিজ বাড়িতে ভার্মি কম্পোস্ট সার তৈরি করছেন। এতে তারা সবাই লাভবান। স্থানীয় কৃষি অফিস তাদেরকে সার্বিক সহযোগিতার পাশাপাশি উৎপাদিত সার বিক্রিতেও সহযোগিতা করে থাকে।
কৃষক মো. সাইদ বলেন, আমি সবজি চাষে প্রথমে অল্প কিছু ভার্মি কম্পোস্ট সার ব্যবহার করে সুফল পেয়েছি, পরে ৬ বিঘা জমিতে সবজিচাষে আমি অধিকাংশ সময় রাসায়নিক সার কম ব্যবহার করে ভার্মি কম্পোস্ট (কেঁচো সার) বেশি ব্যবহার করেছি। এতে সবজিও ভালো ধরেছে, খেতেও অনেক সুস্বাদু।
গোয়ালন্দ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. খোকন উজ্জামান বলেন, ধান, গম, পাটসহ বিভিন্ন শাক-সবজি, ফলবাগানে এ সার ব্যবহার করে ভালো ফলন পাওয়া যায়। এর ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি বাড়ে, মাটিতে বায়ু চলাচল বাড়ে। পানির ধারণক্ষমতা বাড়ে ও বিষাক্ততা দূরীভূত হয়। এছাড়া মাছ চাষের ক্ষেত্রে কেঁচো সার প্রয়োগ করে কম খরচে অতি দ্রুত সুস্বাদু মাছ উৎপাদন করে অধিক মুনাফা অর্জন সম্ভব হয়। ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদনে তেমন কোন খরচ নেই বললেই চলে। নিজেদের বাড়িতে পালিত গরুর গোবর অথবা সামান্য দামে গোবর কিনে এই সার উৎপাদন করা যায়। গোয়ালন্দ উপজেলা এই সার উৎপাদন করে ৫০ জনেরও বেশি নারী স্বাবলম্বী হয়েছেন। এছাড়া ভার্মি কম্পোস্ট সার ব্যবহারে মাটি স্বাস্থ্যবান হয়। বিষমুক্ত শাক-সবজিসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদনে কেঁচো সার খুবই কার্যকর। একজন কৃষক এই সার একবার ব্যবহার করলে, তিনি নিজের তাগিদে এই সারের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
এইচ এমকাদের,সিএনএন বাংলা২৪