ই-পেপার | বৃহস্পতিবার , ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

কৃষিখাতে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ

মুজিব উল্ল্যাহ্ তুষার:

একবিংশ শতাব্দীতে মানবজাতি যখন সভ্যতার চরম শিখরে, ঠিক তখনই জলবায়ু পরিবর্তনের করাল গ্রাস বিশ্বের অস্তিত্বকে আজ প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। বৈরী জলবায়ুর প্রভাব মানবসভ্যতার জন্য আজ সবচেয়ে বড় হুমকি।
Bangladesh Institute of International and Strategic Studies (BIISS) এর মতে
“Climate change is predicated to have an overall negative impact on long term security and conflict d ics, acting as a threat multiplier increases the volatility of exis causes of conflict and many generate new insecurities.

জলবায়ুর এ পরিবর্তনে বাংলাদেশের উত্তর – পশ্চিমাঞ্চলের খরাপ্রবণ এলাকার প্রকোপ বাড়বে। শুধু তাই নয়, সুন্দরবনও সাংঘাতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হবে। পরিবর্তিত এ পরিস্থিতিতে আগামী ২০৫০ সালে বাংলাদেশের এক-পঞ্চমাংশ সমুদ্রে তলিয়ে যাবে। বর্তমানে গ্রীষ্মকালে প্রচন্ড তাপদাহ আবার শীতের প্রকোপ এবং শীতকালে শীতের তীব্রতা এবং কোনো কোনো সময় অনাকাঙ্ক্ষিত গরম পড়া, শীতকালে মুষলধারে বৃষ্টি পড়া, বৃষ্টির দিনে কম বৃষ্টি, অকাল বন্যা, বন্যার দীর্ঘস্থায়ী অবস্থান, শিলাবৃষ্টি এ দেশের আবহমান আবহাওয়ার পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করছে। পঞ্চগড়ে ১০-১২ বছর ধরে অস্বাভাবিক শীতের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় ধানে পোকার আক্রমণও বেড়েছে। শ্রীমঙ্গ এলাকায় বৃষ্টিপাত বেড়ে যাওয়ায় রবিশষ্যের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। অতীতে এ দেশে প্রায় ষাট হাজার প্রজাতির ধান উৎপাদিত হতো। এখন ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হচ্ছে এসব জাত। আগামী ৫০ বছরে ধানের উৎপাদন এক-দশমাংশ কমার আশাস্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এভাবে বিলুপ্ত হতে পারে আলুর বিভিন্ন প্রজাতির এক-চতুর্থাংশ। এছাড়া ২০ শতাংশের বেশি মাছের প্রজাতির অস্তিত্বও হুমকির মুখে পড়েছে।

 

বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে ১৭টি নদী। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এখন সপ্তম। তবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির হিসাবে বাংলাদেশ বিশ্বে পঞ্চম।

 

জলবায়ু পরিবর্তনের লক্ষণগুলো হলো-
১.বর্ষায় বৃষ্টিপাত কম হওয়া।
২. সঠিক সময়ে বৃষ্টিপাত না হওয়া।
৩. সঠিক সময়ে শীত শুরু না হওয়া।
৪. শীতের প্রকোপ কমে যাওয়া।
৫. শীতকালের দৈর্ঘ্য কমে যাওয়া।
৬. প্রতিবছর তাপমাত্রা অল্প করে বৃদ্ধি পাওয়া।
৭. আগাম পানি আসা।
৮. পানির চাপ বৃদ্ধি পাওয়া।

 

২০৩০ সালে বাংলাদেশের জলবায়ুর অবস্থা দাঁড়াবে
★ গরমকালে তাপমাত্রা ০.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং শীতকালে ১.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমবে
★ গরমকালে বৃষ্টিপাত বাড়বে শতকরা ১১ ভাগ কিন্তু শীতকালে কমবে শতকরা ৩ ভাগ
★ গরমকালে বাষ্পীভবন বাড়বে শতকরা ১৮.৮ ভাগ এবং শীতকালে বাড়বে শতকরার ০.৯ ভাগ।

 

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং হুমকির মুখে রয়েছে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা।

কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, বীজ গজানো, পরাগায়ন, ফুল ও ফল ধরা, পরিপক্কতা হতে সুনির্দিষ্ট তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত ও সূর্যালোকও প্রয়োজন। জলবায়ুর এ উপাদানগুলো পরিবর্ণিত হয়েছে, কিন্তু বীজ বপন ও চারা রোপণের সময় পরিবর্তন সম্ভব হয়নি। ফলে কৃষি মৌসুমের সাথে ফসল চাষাবাদ খাপ খাওয়ানো যাচ্ছে না।

 

গড় তাপমাত্রা বাড়ার কারণে গম, ছোলা, মসুর, মুগডালসহ কিছু কিছু ধানের উৎপাদন কমে যাওয়ায় কৃষকরাও এর চাষে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। বাংলাদেশের পরিবেশের ওপর প্রকাশিত ‘টাস্কফোর্স রিপোর্ট” থেকে জানা যায়- সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২০৫০ সাল পর্যন্ত এক মিটার বাড়তে পারে। এর প্রভাবে তিন হাজার মিলিয়ন হেক্টর উর্বর জমি স্থায়ীভাবে হারিয়ে যাবে, ২০০মিলিয়ন টন ধান, গম, আখ, পাট, মটরসহ রবিশষ্য উৎপাদন কমে যাবে।

 

পরিশেষে বলা যায়, সমস্ত প্রতিকূলতা সমুহ সম্ভাবনার মাঝে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের কৃষি। বাংলাদেশের জাতীয় উন্নতির মেরুদন্ড হল আমাদের কৃষক সমাজ। আমাদের দেশের কৃষির উপর অনেকাংশেই নির্ভর করে আমাদের সমাজের গতিশীলতা। সামগ্রিক বিষয় বিবেচনা করলে, বাংলাদেশের কৃষিকে যুগোপযোগী আধুনিকায়ন ও কৃষকের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন এই দুইটি বিষয়কে পাশাপাশি রাখলে আমাদের দেশীয় কৃষি হতে পারে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের শ্রেষ্ঠ মডেল
কৃষি এ দেশের অর্থনীতির এক অতি গুরুত্বপূর্ণ খাত। বর্তমানে দেশে জিডিপির প্রায় এক-পঞ্চমাংশ অর্জিত হয় কৃষিখাত থেকে। তার চেয়েও বড় কথা কৃষি এদেশের জনমানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা প্রদানের প্রধানতম এবং অন্যতম উৎস।

এখনও এ দেশের বিপুল কর্মসংস্থানও হয়ে থাকে কৃষিকে অবলম্বন করেই।ফলে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য খাদ্য সরবাহ নিশ্চিতকরণ জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হলে কৃষিক্ষেত্রে অধিকতর মনোযোগ দিতে হবে। কৃষিক্ষেত্রে বিরাজমান সকল সমস্যা সমাধান করার মধ্য দিয়ে অবিলম্বেই উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে এদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব। কৃষি উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন কৃষিতে উচ্চতর ও আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ জনশক্তি। এ দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য সময় উপযোগী কৃষিশিক্ষা ও গবেষণার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও পরিবেশ আন্দোলনকর্মী।

 

এইচ এম কাদে,সিএনএন বাংলা২৪