শিব্বির আহমদ রানা,বাঁশখালী প্রতিনিধি:
#পোড়ানো হচ্ছে বনের কাঠ, জলকদরের মাটি দিয়ে তৈরি হচ্ছে ইট।
#ভাটার ত্রি-সীমানায় কয়েক হাজার লোকের বসবাস, মিলেছে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র
#জাতীয় গ্রিডের ৪০০ কেভি’র বিদ্যুৎ লাইনটিও ইটের ভাটার উপর দিয়ে প্রবাহিত।
সাদা সোনা খ্যাত লবণ শিল্পের জন্য চট্টগ্রামের বাঁশখালী সমধিক পরিচিত। উপকূলীয় এলাকার মধ্যে লবণ উৎপাদনে সরল ইউনিয়নের পশ্চিমাঞ্চলও তার অন্যতম অংশীদার। উপজেলার সরল ইউনিয়নের মিনজিরিতলা গ্রামের পশ্চিমে জলকদর ঘেষে বিস্তীর্ণ লবণ মাঠ। লবণ মাঠের উপর দিয়ে বয়ে গেছে কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে সংযুক্ত জাতীয় গ্রিডের বৈদ্যুতিক লাইন। লবণ মাঠেই গড়ে উঠেছে মহিউদ্দিন চৌধুরী জাহাঙ্গীরের মালিকানাধীন মেসার্স চৌধুরী ব্রিকস ম্যানুফ্যাকচার নামের একটি ইটভাটা। তৈরি হচ্ছে লবণাক্ত মাটি দিয়ে ইট। ইটের জন্য কাটা হচ্ছে জলকদরের মাটি। পোড়ানো হচ্ছে বনের কাঠ। ব্যাহত হচ্ছে লবণ উৎপাদন। এভাবেই চলছে নিত্যকর্মযজ্ঞ। নির্বিকার উপজেলা প্রশাসন।
সরেজমিনে দেখা যায়, উপকূলীয় সরল ইউনিয়নের মিনজিরতলায় বিস্তীর্ণ লবণ মাঠে ইটের ভাটায় তৈরি হচ্ছে লবণাক্ত মাটি দিয়ে ইট। ব্যাহত হচ্ছে লবণ উৎপাদন। মাঠের কোলঘেষেই বাঁশখালীর জলকদর খাল। খালের মাটি কেটে ট্রাকে করে ইটভাটায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আট হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৪০০ কেভি’র বৈদ্যুতিক সঞ্চালন লাইনের নিচে এবং লবণ মাঠেই ইটভাটা স্থাপনে পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়পত্র দিয়েছে।
মহেশখালীর-মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্র (১৩২০ মেগাওয়াট) এবং বাঁশখালীর কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র (১৩২০ মেগাওয়াট) থেকে উৎপাদিত ২৬৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাঁশখালীর ওপর দিয়ে মদুনাঘাট ও নারায়ণগঞ্জ হয়ে জাতীয় গ্রিডে প্রতিদিন বিদ্যুৎ সরবরাহ হচ্ছে। ওখানে গত ১০০ বছর ধরে কমপক্ষে ২০ একর জমিতে লবণ উৎপাদন হয়ে আসছে। এই যেন সাদা সোনার বুকে কালো ধোয়া ছড়ানোর অনুমতি! বায়ুদূষণ তো হচ্ছেই। কাটা হচ্ছে জলকদরের মাটি, পোড়ানো হচ্ছে বনের কাঠ। সচেতন মহলের প্রশ্ন পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়পত্র দেয় কেমনে?
বিস্তীর্ণ লবণ মাঠের ত্রি-সীমানায় লোকালয়। সরল ইউনিয়নের পশ্চিম মিনজিরিতলা গ্রামের কয়েক হাজার লোকের বসবাস এখানেই। নতুনভাবে টাঙানো এই বৈদ্যুতিক লাইন দিয়ে ইটভাটার ধোয়ায় নতুনভাবে স্থাপিত বৈদ্যুতিক তারে মরিচা ধরছে। যখন ওই তার দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হবে মরিচা ধরা তার ছিড়ে গিয়ে ৪ লাখ ভোল্টের বিদ্যুতে গ্রামে ভয়ংকর বিপদ হতে পারে এমনটাই আশংকা করছে স্থানীয়রা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ইটভাটার প্রভাবশালী মালিক স্থানীয় লবণ মাঠের মালিকদের প্রভাবিত করে বিস্তীর্ণ লবণমাঠ দখল করে ইট তৈরি করছেন। বনের কাঠ দিয়ে ইট পুড়ছে এবং জলকদর খালের পাড় থেকে লবণাক্ত মাটি কেটে মজুদ করছেন। প্রতিদিন পশ্চিম মিনজিরিতলা গ্রাম ধোয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলেও গ্রামবাসী প্রতিবাদ করে রেহাই পাচ্ছে না। এমন দৃশ্যটি নজরে পড়ছে না প্রশাসনের এমনটাই আক্ষেপ তাদের।
স্থানীয় বেশকয়েকজন কৃষক অভিযোগ করে বলেন, জলকদর খালের লবণাক্ত পানি ব্যবহার করে এতোদিন লবণ উৎপাদন করে আসছি। ইটভাটার মালিক জলকদর খালের পাড় কেটে মাটি নিয়ে ইট তৈরি করায় লবণ মৌসুম শেষ হলে জলকদর খালের পাড় ভেঙে বর্ষার পানি ঢুকলে চাষাবাদও করা যাবে না। অনায়সে প্লাবিত হবে গ্রামাঞ্চল। বর্তমানে ইটভাটার মালিক ব্যাপক লবণ মাঠ দখল করে ইটভাটা তৈরি করছে। দিনদিন কমে যাচ্ছে লবণমাঠ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, লবণাক্ত ইট দিয়ে নির্মিত ভবন মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। লবণের মাঠ ও উপকূলীয় এলাকায় হওয়ায় পরিবেশের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। পরিবেশ অধিদপ্তর জানিয়েছে, স্থানীয় বিভিন্ন কর্মকর্তার অনাপত্তি পত্র পেয়ে তারা মহিউদ্দিন চৌধুরী জাহাঙ্গীরের মালিকানাধীন মেসার্স চৌধুরী ব্রিকস ম্যানুফ্যাকচার নামের ইটভাটাটিকে ছাড়পত্র দিয়েছেন। মাঠপর্যায়ে সবকিছু খুঁটিনাটি দেখা তাদের পক্ষে সম্ভব নয় বলে জানান। বাঁশখালী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যালয়ের সিনিয়র হকারী প্রকৌশলী লিপ্টম ওম বলেন, ‘ইটে যদি লবণাক্ততার পরিমাণ নির্দিষ্ট সীমার বেশি হয় তাহলে ইট দিয়ে তৈরি ভবনের স্থায়িত্ব কমে অল্প সময়ের মধ্যে খসে পড়তে পারে।’
বাঁশখালী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) রীশু কুমার ঘোষ বলেন, ‘জাতীয় গ্রিডের ৪০০ কেভি বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের নিচে ইটভাটা রাখা যাবে না। এই সঞ্চালন লাইনটি দেখভাল করে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (পিজিসিবি)। বিষয়টি পিজিসিবি কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছি।’
ইটভাটার মালিক মহিউদ্দিন চৌধুরী জাহাঙ্গীর বলেন, লাখ লাখ টাকা খরচ করে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে ইটভাটা করছি। গ্রামে কারো আপত্তি নেই। এখানে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। তারও প্রশ্ন- পরিবেশের ক্ষতি হলে পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়পত্র দিল কিভাবে? ইটভাটার লাইসেন্স পেয়েছেন কী না এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর না দিয়ে নীরব থাকেন মহিউদ্দিন চৌধুরী।
পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলার উপপরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ার দৈনিক ভোরের দর্পণ কে বলেন, ‘লবণ মাঠে কৃষি জমিতে কিংবা বৈদ্যুতিক লাইন টাঙানো থাকলেও ইটের ভাটা করা যাবে। এতে পরিবেশের ক্ষতি হওয়ার কথা না। লোকালয়ে ইটের ভাটা পরিবেশ দূষণ করছে না? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন তেমন অসুবিধা হবে না। বাঁশখালীর সরলের মিনজিরিতলা গ্রামের ইটভাটাটি স্থানীয় প্রশাসনের অনাপত্তি পেয়ে ছাড়পত্র দিয়েছি। মাঠে-ঘাটে সব কিছু দেখাতো সম্ভব না।’