ই-পেপার | শনিবার , ২৯শে জুন, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

স্বপ্ন এখন শুধু সামনে এগিয়ে যাওয়ার

নিজস্ব প্রতিবেদক

চারদিকে সবুজ গাছগাছালি। পাকা সড়ক থেকে ফসলি জমির পাশ দিয়ে ইটের রাস্তা ধরে প্রায় এক মিনিট হাঁটলে মিলবে একটি তাল গাছ। সেই তাল গাছে থাকা বাবুই পাখির বাসা জানান দিচ্ছে, নিজ ঘরে থাকতে পারার সুখ কতখানি।

বলছি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের আমানউল্লাহপুরে আশ্রয়ণ প্রকল্পের কথা। এ আশ্রয়ণ প্রকল্পে পুনর্বাসিত হয়েছে ভূমিহীন-গৃহহীন ৫০টি পরিবার। যাদের নিজস্ব মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না। যারা স্বপ্ন দেখত এক টুকরো ভিটের, তারা এখন জমিসহ একটি পাকা ঘরের মালিক। ঘর পাওয়া এসব মানুষরা এখন স্বপ্ন দেখছে সামনে এগিয়ে যাওয়ার। সমাজে মাথা উঁচু করে চলার। মূল ধারার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিজেকে জানান দেওয়ার।

নাজমা বেগম প্রধানমন্ত্রীর উপহারের একটি পাকা ঘর পেয়েছেন। তার বড় ছেলে এবার লক্ষীপুরের কফিল উদ্দিন ডিগ্রি কলেজে স্নাতক প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছেন।

ছেলে মোহাম্মদ ফয়সাল বলেন, ‘রাস্তায় সরকারি জায়গার ওপর থাকতাম। সব সময় ভয়ে থাকতাম কখন যে উঠাইয়া দেয়। মা অনেক কষ্ট করে পড়ালেখাটা চালাইয়া গেছে। হিসাববিজ্ঞানে অনার্সে ভর্তি হইছি। সরকার ঘর দিয়েছে। এই ঘর থেকে অনার্স পড়া শেষ করতে চাই। জীবনে বড় কিছু হতে চাই।’

২৭ বছর আগে স্বামী হারান মরিয়ম বেগম। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে ভিক্ষা করতে হয়েছে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে। বর্তমানে শারীরিকভাবে অসুস্থ মরিয়মের কথা বলতে কষ্ট হয়। পাশ থেকে বোন রোজিনা মরিয়মের জীবনের করুণ গল্প বলছেন। আর মরিয়মের চোখ দিয়ে অজোরে অশ্রু ঝরছে।

চোখের পানি ফেলতে ফেলতে মরিয়ম বলেন, ‘আন্নেরা ঘর দিছেন, আল্লা আন্নেগো ভালা করোক। প্রধানমন্ত্রী আন্নের লাই দোয়া করি। আল্লা আন্নের ভালা করুক।’

পুনর্বাসিতরা বলছেন, মাথা গোঁজার ঠাঁই হওয়াকে তারা জীবনের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হিসেবে দেখছেন। তারা এখন স্বপ্ন দেখেন সন্তানদের শিক্ষিত করার। পরিশ্রম করে পরিবর্তন করতে চান ভাগ্যের চাকার।

 

আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় বুধবার (৯ আগস্ট) সারাদেশে ২২ হাজার ১০১টি পাকা ঘর হস্তান্তর করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদিন নোয়াখালী জেলায় ৪১৮ ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে ঘর হস্তান্তর করা হবে। এর মধ্যে বেগমগঞ্জের আমানউল্লাহপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পে ৫০টি পরিবারকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘর হস্তান্তর করা হবে।

 

মঙ্গলবার (৮ আগস্ট) আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বেগমগঞ্জের আমানউল্লাহপুর আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকায় সাজ সাজ রব। ঘর পাওয়া পরিবার ছাড়াও এলাকার স্থানীয়দের মধ্যেও আনন্দ বিরাজ করছে।

স্থানীয় বাসিন্দা নূর আলম বলেন, ‘উদ্বাস্তুদের বাঁচার অধিকার আছে। সরকার তাদের ঘর দিছে, আমরা খুশি। তারা এখন আমাদের প্রতিবেশী। আমরা তাদের ভালোভাবে গ্রহণ করেছি। আমাদের কাজের লোকের অভাব। আমরা চাইলে তাদের কাজে লাগাতে পারব।’

আমানউল্লাহপুরের আরেক বাসিন্দা জামাল হোসেন বলেন, ‘এদের সঙ্গে তো অনেকের মিলবে না। সখ্যতা তৈরি হবে কি না সময় বলে দেবে। আপাতত, কিছুই বলা ঠিক হবে না। তবে আমাদের চাওয়া হচ্ছে, পরিবেশটা যেন নষ্ট না হয়ে যায় আবার।’

 

আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর পাওয়া হাসিনার স্বামী মো. রাজু বলেন, ‘আমাদের মতো অসহায় লোকদের প্রধানমন্ত্রী ঘর দিছে। আমরা প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। এলাকার লোকজন অনেকে ভালোভাবে নিচ্ছে আমাদের। আবার অনেকে বিভিন্ন রকমের কথা বলে। এক জায়গায় থাকতে গেলে সবাইরে মিলে চলতে হবে।’

সিএনএন বাংলা২৪

আমানউল্লাহপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. বাহারুল আলম সিএনএন বাংলা২৪কে বলেন, ‘এ আশ্রয়ণ প্রকল্প এক একর ২৩ শতাংশ জায়গার ওপর করা হয়েছে। একেক জনের ভাগে প্রায় ২ শতাংশ জায়গা পড়েছে। এখানে মোট ৫০টা ঘর আছে। বাঁধের গোড়ায় থাকা ভূমিহীন ৪৫ জনকে এখানে ঘর দেওয়া হয়েছে। গোপালপুর ইউনিয়নের চারজনকে দেওয়া হয়েছে, আর একজন আলাইয়াপুরের।’

বাহারুল আলম বলেন, ‘যার কিছুই ছিল না, যারা ভাসমান ছিল তাদের এখানে পুনর্বাসন করা হয়েছে। ঘর পেয়ে তারা খুব খুশি। ছিন্নমূল জনগোষ্ঠীকে বা পিছিয়ে পড়াদের এ আশ্রয়ণের মাধ্যমে মূল ধারার লোকদের সঙ্গে নিয়ে আসা সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে আমার দিক থেকে আমি সব ধরনের সহযোগিতা করব। আমরা আশা করি, তারা সবাই মিলেমিশে চলবে।’

 

বেগমগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইয়াসির আরাফাত বলেন, এ আশ্রয়ণ প্রকল্পে ৫০টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এ জায়গাটা প্রায় দেড় কোটি টাকায় ক্রয় করা হয়েছে। এরা আগে রাস্তার পাশে সেতুর নিচে থাকত, অস্থায়ীভাবে ছিল। তারা কখনও কল্পনা করেনি, তারা ঘর পাবে। তারা জানে প্রধানমন্ত্রী তাদের ঘর দিয়েছে। যারা ঘর পেয়েছেন তারা সব সুবিধা মিলিয়ে বলা যায়, প্রায় ১০ লাখ টাকার মালিক হয়ে গেছে। তাদের জন্য অনেক কিছু বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তারা শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা হাতের নাগালেই পাবে।

 

আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় সারা দেশে ২২ হাজার ১০১টি ঘর হস্তান্তরের মাধ্যমে যে কয়টি উপজেলাকে ভূমিহীন-গৃহহীন ঘোষণা করা হবে তার মধ্যে একটি হতে যাচ্ছে বেগমগঞ্জ উপজেলা। উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, আমরা বেগমগঞ্জ উপজেলাকে ভূমিহীন-গৃহহীন মুক্ত করব। একজন মানুষও আর গৃহহীন থাকবে না। তারপরও পরবর্তীতে যদি কোনো গৃহহীন পাওয়া যায় তাদের পুনর্বাসন করা হবে।

 

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তথ্য বল‌ছে, আশ্রয়ণ প্রকল্প ইতোমধ্যে ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৬১৭ পরিবারকে পুনর্বাসন করেছে। এছাড়া ভূমি মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের বিভিন্ন কর্মসূচির অধীনে ২ লাখ ৭৩ হাজার ৯৯০ পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।

 

১৯৭২ সালে গৃহহীনদের পুনর্বাসন কর্মসূচি চালু করেন জা‌তির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মু‌জিবুর রহমান। তার দেখা‌নো প‌থে কন্যা শেখ হা‌সিনা ১৯৯৭ সালে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে গৃহহীন ও ভূমিহীনদের বাড়ি ও জমির মালিকানা দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ১৯৯৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত মোট ৮ লাখ ২৯ হাজার ৬০৭টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। আর পুনর্বাসিত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪১ লাখ ৪৮ হাজার ৩৫ জন।

 

এইচ এম কাদের,সিএনএন  বাংলা২৪