ই-পেপার | শুক্রবার , ১৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

পেটের ক্ষুধা ‘দিবস’ বুঝে না

চট্টগ্রাম ব্যুরো:

চট্টগ্রাম: নগরের চকবাজারে কাঁচাবাজার মোড়। যেখানে বসে ‘মানুষের হাট’।

কেউ খেয়ে, কেউ না খেয়ে এসেছেন শ্রম বেচাকেনার হাটে। তাদের হাতে বাঁশের ডালি, কোদাল, রশি, দুপুরের খাবারের টিফিন বাটি।

আর এখান থেকেই চাহিদা অনুযায়ী শ্রমিক নিয়ে যান মালিকেরা। এই চিত্র নিত্যদিনের।
ভোর হতেই একে একে জড়ো হতে থাকেন শ্রমজীবী নিম্ন আয়ের রাজমিস্ত্রী, মাটি কাটা এবং সরকারি প্রকল্পের বিভিন্ন ভবন ও রাস্তাঘাটে কাজ করা শ্রমিকরা। সকাল ৮টার মধ্যেই নানা পেশার শ্রমজীবী মানুষে সরগরম হয়ে ওঠে নগরের বিভিন্ন মোড়।

দেশে টানা দুই সপ্তাহজুড়ে চলছে হিট অ্যালার্ট। এ তপ্ত রোদ থেকে বাচঁতে পাখিরাও যখন গাছের ডালে আশ্রয় নিচ্ছে, ঘর থেকে বের হচ্ছে না মানুষ, পেটের দায়ে তখনও ভোর থেকেই চট্টগ্রামের মোড়ে মোড়ে দেখা যায় শ্রমজীবী মানুষের জটলা। পেটের দায়ে আগুন ঝরা রোদে পুড়ে কাজ করতেই তাদের এ জটলা। সারাদিন কাজ করে মিলে অল্প মজুরি। সেটাই পুরো পরিবারের বেঁচে থাকার পাথেয়।

বুধবার (১ মে) মহান মে দিবস। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের এ দিনটি সারা বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণির কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বহির্বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হচ্ছে নানা আয়োজনে। কিন্তু যাদের অধিকার আদায়ের জন্য এ দিনটি পালন করা হয়, তাদের অনেকেই জানেন না দিবসটি সম্পর্কে। পেটে ক্ষুধা নিয়ে তা জানার প্রয়োজনও পড়ে না।

দারিদ্র্য আর অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে দিন কেটে যায় মেহনতি মানুষগুলোর। নিজের কথা চিন্তা না করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যেতে হয় শ্রমজীবী মানুষকে। মেহনতি মানুষের অধিকার আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

চকবাজারে কথা হয় কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে। বললেন, ন্যায্য মজুরি পান না তারা। বছরের অন্যান্য দিনের মতো এ দিনেও প্রখর রোদ মাথায় নিয়ে কাজ করে যেতে হবে। পেটের ক্ষুধা কোনও ‘দিবস’ বুঝে না।

নগরের হামজারবাগে নির্মানাধীন একটি ভবনের শ্রমিক আব্দুল আলীম বাংলানিউজকে বলেন, মে দিবস আবার কি? সারাবছরই সকাল থেকে সন্ধ্যা আমাদের কাজ করতে হয়। দিবস দিয়ে তো আর পেটে ভাত জুটবে না। আমাদের কাজ আর কেউ করে দিবে না। কাজ না করলে টাকা দিবে না। এসব দিবস আসে যায়, কিন্তু আমাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না।

তপ্ত রোদে নগরের বহদ্দারহাট আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারে ঝাড়ু দিচ্ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা। এসময় বালি একত্রিত করছিলেন লুবনা আর পপি। সেই বালি ছোট একটি ঠ্যালা ভ্যানে তুলে নিচ্ছেন রহিম উল্লাহ। রহিম উল্লাহর সঙ্গে কথা হয় সিএনএন বাংলা২৪কে । তিনি বলেন, সারাদিন কাজ করে যেতে হয়। রোদ হোক আর শীত হোক। যা বেতন পাই তা দিয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হয়।

একই কথা বলেন ফটিকছড়ির নানুপুর গ্রামের শ্রমিক মিলন। তিনি বলেন, ছোটবেলায় মা-বাবা পড়ালেখা করাতে চেয়েছিল। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ইট ভাঙার কাজ শুরু করি। যা পাই তা দিয়ে কোন রকম সংসার চলছে। মে দিবস এলেই অধিকারের কথা শুনি। এরপর আর শুনি না।

মুরাদপুরের গ্রিল মেকানিক রমিজ উদ্দিন সিএনএন বাংলা২৪কে বলেন, এই মে দিবস এলেই র‌্যালি আর আলোচনা সভায় যাওয়ার জন্য ফোন করে। ওখানে গিয়ে কোনো লাভ হয় না। পাঁচ বছর আগেও যে মজুরি পেতাম, এখনো তাই পাই। কাজ করতে হয় ১২ ঘণ্টারও বেশি।

নির্মাণ শ্রমিক হানিফ মিয়া বলেন, প্রতিবছর মে দিবস আসে আর যায়। শ্রমিকদের ভাগ্য পরিবর্তন হয় না। আমরা যেসব দিক দিয়ে বঞ্চিত, তা কখনোই পাই না। না বাড়ে মজুরি, না কমে কাজের সময়।

নগরের হামজারবাগ এলাকার বাবুল ম্যানশনে স্বামীসহ ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন সিলেটের মনোয়ারা বেগম। বছর দুয়েকের মধ্যে স্ত্রীকে রেখে চলে যান স্বামী মো. দেলোয়ার। সেই থেকে এখনো ফিরেনি মনোয়ারার স্বামী। এরই মধ্যে জন্ম নেওয়া একমাত্র পুত্র সন্তানও মারা যায়। জীবিকার তাগিদে মনোয়ারা কিছুদিন মানুষের বাসাবাড়িতে কাজ করেন। এরপর গার্মেন্টসে। অসুস্থ হওয়ায় গার্মেন্টেস থেকে চাকরিচ্যুত হন মনোয়ারা। মানুষের বাসায় গিয়ে কাজকর্ম করে চলছে নিজের একাকি জীবন। কাজ না পেলে ভিক্ষা করতে হয় মনোয়ারার। তার কাছে মে দিবস একটি অপরিচিত শব্দ।

১৮৮৬ সালের এ দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা কাজ, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম ও ৮ ঘণ্টা বিনোদনের দাবিতে রাজপথে নেমেছিলেন। সে আন্দোলনে শ্রমিকরা জীবনও উৎসর্গ করেছিলেন। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য শ্রমিকদের আত্মত্যাগের এই দিনকে তখন থেকেই সারা বিশ্বে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালন করা হচ্ছে। এবারের মে দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়: ‘শ্রমিক-মালিক ঐক্য গড়ি, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলি’।