ই-পেপার | শুক্রবার , ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ইসরায়েলি হামলার প্রতিশোধ নিতে ইরানের সামনে একাধিক বিকল্প

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

সিরিয়ায় ইরানি কনস্যুলেটে ইসরায়েলি হামলায় দেশটির বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসির শীর্ষ দুই কমান্ডারসহ ১১ জন নিহত হয়েছেন। সেই ঘটনার প্রতিশোধ দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছে ইরানি প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিও একই কথা উচ্চারণ করেছেন।

 

ইরানের সামনে প্রতিশোধ নেওয়ার অনেক উপায় আছেও। কিন্তু সেই উপায়ের আশ্রয় নিলে সমূহ ক্ষতির ঝুঁকিও আছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইরান যদি ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর প্রতিশোধ নিতে চায় তাহলে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে টানাপোড়েন শুরু হয়ে যেতে পারে। যা ইরান নিজেও চায় না।

 

ইরান মোটা দাগে যেভাবে প্রতিশোধ নিতে পারে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—দেশটি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে সিরিয়া ও ইরাকে মার্কিন সেনাদের ওপর তাঁর মিত্র সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে লেলিয়ে দিতে পারে। হিজবুল্লাহ-হুতি গোষ্ঠীর মতো ইরানি অনেক প্রক্সি গোষ্ঠীই ইসরায়েলের প্রতিবেশী অনেক দেশেই আছে। সেসব দেশ থেকে তাঁরা ইসরায়েলে সরাসরি হামলা চালাতে পারে। এ ছাড়া, ইরানের পরমাণু কর্মসূচির গতি আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।

 

তবে ইরান কোন ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে সে বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সচেতন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মার্কিন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ইরাক ও সিরিয়ায় মার্কিন সেনাদের ওপর ইরানি প্রক্সি গোষ্ঠীগুলো হামলা চালায় কি না সে বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ওয়াশিংটন।

 

সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত কে এই ইরানি জেনারেল জাহেদিসিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত কে এই ইরানি জেনারেল জাহেদি এর আগে, জর্ডান সীমান্তে এক গোষ্ঠীর হামলায় ৩ মার্কিন সেনা নিহত হয়। পরে ইরাকেও মার্কিন সেনাদের ওপর হামলা চালানো হয়, যদিও সেখানে কেউই হতাহত হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, এই গোষ্ঠীগুলো ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর অর্থায়ন ও নির্দেশে পরিচালিত হয়।

 

তবে ইরানে প্রক্সি গোষ্ঠীগুলো ‘প্রতিশোধমূলক’ হামলার পরিকল্পনা করছে এমন কোনো খবর পায়নি। তারপরও যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে আগেভাগেই এ ধরনের কোনো হামলার ব্যাপারে সতর্ক করেছে। অবশ্যই ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির আব্দুল্লাহিয়ানও হামলার পর জানিয়েছিলেন, ইরান যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কঠোর বার্তা পাঠিয়েছে।

 

জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন উপরাষ্ট্রদূত রবার্ট উড বলেছেন, ‘আমরা আমাদের লোকবল রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করব না এবং ইরান ও তার প্রক্সিদের পরিস্থিতির সুযোগ না নেওয়ার জন্য আমাদের পূর্বের সতর্কতারই পুনরাবৃত্তি করব…যেন তাঁরা মার্কিন লোকবলের ওপর পুনরায় আক্রমণ শুরু না করে।’

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানিয়েছে, সিরিয়ার ইরানি কনস্যুলেটে হামলার প্রতিশোধ নেওয়ার বিষয়ে ধাঁধায় পড়ে গেছে ইরান। এক দিকে, তাদের প্রতিশোধ নেওয়ার চাপ অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্য একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ এড়ানো। সূত্রটি বলেছে, ‘তারা (তেহরান) সত্যিকারের একটি ধাঁধার মুখোমুখি হয়েছে। তাঁরা যদি প্রতিক্রিয়া জানায়, তবে একটি সংঘর্ষের মুখোমুখি হতে হবে—যা তারা স্পষ্টতই চায় না। তারা তাদের ক্রিয়াকলাপকে এমনভাবে সাজানোর চেষ্টা করছে যাতে মনে হয়—তাঁরা প্রতিশোধই নিচ্ছে কিন্তু উসকানি দিচ্ছে না।’

 

সূত্রটি আরও বলেছে, ‘যদি তাঁরা এই হামলার প্রতিক্রিয়া না দেখায় তাহলে একটি প্রমাণিত হয়ে যাবে যে, তাদের যে ডিটারেন্স বা প্রতিরোধ ক্ষমতা তা আসলে কাগজে-কলমে।’ তিনি জানান, ইরান হয়তো সরাসরি ইসরায়েলে হামলা চালাতে পারে, বিদেশে ইসরায়েলি দূতাবাস ও ইহুদি অবকাঠামোর ওপরও হামলা চালাতে পারে।

 

সিরিয়ার ইরানি দূতাবাসে ইসরায়েলি হামলা, শীর্ষ কমান্ডারসহ নিহত ৮সিরিয়ার ইরানি দূতাবাসে ইসরায়েলি হামলা, শীর্ষ কমান্ডারসহ নিহত ৮ একই সুরে কথা বলেছেন, মার্কিন কর্মকর্তারাও। তাঁরা বলছেন, সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলার পর ইরান হয়তো কেবল ইসরায়েলের ওপরই দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখবে, যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের পিছু নেবে না। এ বিষয়ে মার্কিন থিংকট্যাংক কাউন্সিল অন ফরেইন রিলেশনের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক এলিয়ট আব্রামস বলেন, তাঁর বিশ্বাস, ইরান ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়াবে না তবে ইসরায়েলি স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে এমন সব জায়গাকে লক্ষ্যবস্তু করবে।

 

আব্রামস বলেন, ‘আমি মনে করি, ইরান এই মুহূর্তে বড় পরিসরে ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ যুদ্ধ চায়। তাই হিজবুল্লাহর পক্ষ থেকেও বড় কোনো প্রতিক্রিয়া এই মুহূর্তে আসবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিশোধ নেওয়ার আরও অনেক উপায় তাদের আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়…তাঁরা ইসরায়েলি দূতাবাস উড়িয়ে দিতে পারে।’

 

ইসরায়েলি হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরান পারমাণবিক কর্মসূচির গতি ত্বরান্বিত করতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ইরান দুটি দিকে যেতে পারে: (১) তাঁরা ইউরেনিয়ামকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ করতে পারে যা দিয়ে বোমা তৈরি সম্ভব এবং (২) কর্মসূচি পুনরুজ্জীবিত করে একটি প্রকৃত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির করা দিকে যেতে পারে।

 

মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে দিচ্ছে ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে দিচ্ছে ইসরায়েল তবে এ ক্ষেত্রে বিষয়টি হিতে বিপরীতও হতে পরে। কারণ, ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি জানতে পারলে তাঁরা ইরানে সরাসরি হামলাও করে বসতে পারে। এ বিষয় অপর একটি সূত্র বলেছে, ‘এই দুটি উদ্যোগের যেকোনো একটিকে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক বোমা অর্জনের সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখবে। তাই…তাঁরা (ইরান) সত্যিই একটি বড় ঝুঁকি নিচ্ছে। তাঁরা কি এটি মোকাবিলা করতে প্রস্তুত? আমি তা মনে করি না।’

 

তবে মার্কিন থিংকট্যাংক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের মধ্যপ্রাচ্য প্রোগ্রামের পরিচালক জন অল্টারম্যান বলছেন, তাঁর মনে হয় না যে, ইরান তার দূতাবাসে হামলার কড়া জবাব দেবে। তিনি বলেন, ‘ইরান ইসরায়েলকে শিক্ষা দেওয়ায় যতটা না আগ্রহী তার চেয়ে বেশি আগ্রহী, মধ্যপ্রাচ্যের মিত্রদের কাছে নিজেদের শক্তিমত্তা দেখানোর বিষয়ে।’