ই-পেপার | শুক্রবার , ১৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সমুদ্রের অংশ হয়ে যেতে পারে দক্ষিণাঞ্চলের বিশাল এলাকা: ড. আইনুন নিশাত 

শামসুল আলম শ্রাবণ :

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে চরম ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় কয়েকটি জেলা। এসব জেলার অংশবিশেষ আগামী ১০০ বছরের মধ্যে সমুদ্রের অংশ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত। এই পরিবর্তনটা আগামী ৫০ বছরের মধ্যেও হতে পারে বলে জানিয়েছেন তিনি। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সারাদেশেই পড়ছে বলে জানান এই বিশেষজ্ঞ।

 

শনিবার (৩০ মার্চ) রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক জাতীয় সংলাপে তিনি এসব কথা বলেন।

 

পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক জাতীয় সংগঠন ‘ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) ‘উপকূলের জীবন ও জীবিকা: সংকট ও করণীয়’ শীর্ষক এই জাতীয় সংলাপের আয়োজন করে।

 

রোমান ক্যাথলিক চার্চ, ঢাকা-র আর্চবিশপ বিজয় নিসফরাস ডি’ক্রুজ ওএমআই’র সভাপতিত্বে এবং ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)’র সদস্যসচিব শরীফ জামিলের সঞ্চালনায় সংলাপে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর মির মোহাম্মদ আলি এবং ব্লু প্ল্যানেট ইনিশিয়েটিভের গবেষণা ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন ব্যবস্থাপক মো. ইকবাল ফারুক।

 

সংলাপে সম্মানিত আলোচক হিসেবে ছিলেন- বাংলাদেশ নদী কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার, ব্রতী’র নির্বাহী পরিচালক ও ধরা-র সহআহবায়ক শরমিন মুরশিদ, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের বেসরকারি উপদেষ্টা ও ধরা-র সহআহবায়ক এমএস সিদ্দিকি এবং সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ও সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার।

 

উপকূল রক্ষায় আমরা-র সমন্বয়ক নিখিল চন্দ্র ভদ্র’র স্বাগত বক্তব্যে শুরু হওয়া সংলাপে আলোচনায় অংশ নেন- সুন্দরবন রক্ষায় আমরা-র সমন্বয়ক নুর আলম শেখ, চুনতি রক্ষায় আমরা-র সমন্বয়ক সানজিদা রহমান, কক্সবাজারের পরিবেশকর্মী এইচএম ফরিদুল আলম শাহীন এবং সাংবাদিক তৌহিদ বেলাল, মহেশখালীর পরিবেশকর্মী জেএইচএম ইউনুস, বরগুনার পরিবেশকর্মী শফিকুল ইসলাম খোকন, পটুয়াখালীর কলাপাড়ার মুহাম্মদ আল ইমরান, বরগুনার তালতলির কৃষক রফিকুল ইসলাম, বাগেরহাটের ক্ষতিগ্রস্ত নারী কমলা সরকার, বনজীবী ইসরাফিল বয়াতি, তালতলির টেংবাগিরির আরিফুর রহমান ও স্কুলশিক্ষার্থী প্রজ্ঞা নুর।

 

জাতিসংঘের সংস্থা ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) একটি প্রতিবেদনের আলোকে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, ১০০ বছরের মধ্যে যশোর থেকে গোপালগঞ্জ, গোপালগঞ্জ থেকে চাঁদপুর ও চাঁদপুর থেকে ফেনী- এসব জেলার দক্ষিণাংশ সমুদ্রের অংশ হয়ে যাবে। এই পরিবর্তন ৫০ বছরের মধ্যেও হয়ে যেতে পারে।

 

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, রাজশাহী থেকে সিরাজগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ থেকে কিশোরগঞ্জের ভৈরব- এই সারির মধ্যাঞ্চল লবণাক্ত হয়ে যাবে। ঢাকা শহর খুব উঁচু। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ২৫ ফুট। ঢাকা শহরের চারপাশ লবণাক্ত হয়ে যাবে। কামরাঙ্গিরচর বা জিঞ্জিরার উচ্চতা পাঁচ থেকে ছয় ফুট। এসব এলাকা পানির তলায় চলে যেতে পারে।

 

লবণাক্ততার সমস্যার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ভারতকে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের সম্মতি দেওয়ার মধ্যদিয়ে লবণাক্ততা সমস্যার শুরু। উজান থেকে পানি আসা বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে লবণাক্ততা বাড়া শুরু হয়েছে।

 

ড. আইনুন নিশাত বলেন, প্রকৃতি বদলাচ্ছে। আমাদের এই প্রকৃতিকে বুঝতে হবে। ষড়ঋতুর বাংলাদেশ আজ চার ঋতুতে পরিণত হয়েছে। আষাঢ়েও এখন বৃষ্টির দেখা পাওয়া যায় না। ফলে জীবন-জীবিকায় সংকট বাড়ছে।

 

এই জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, তাই উপকূলের মানুষ ভালো নেই। আগামীতে উপকূলে জলোচ্ছ্বাস ও দুর্যোগ বাড়বে। যা মোকাবেলায় প্রস্তুতি বাড়াতে হবে। এই কাজে কমিউনিটির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

 

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, নদীর দখল করে প্রস্তুত করা স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হবে। নদী দখল করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা যাবে না। নদী বাঁচাতে হবে। পরিবেশ বাঁচাতে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

 

ধরা’র সহ-আহ্বায়ক শরমীন মুরশিদ বলেন, নদী হলো পাবলিক প্রপার্টি। এই নদীতে বাঁধ দেওয়া হচ্ছে কার সিদ্ধান্ত? নদীতে বর্জ্য ফেলা আইন করে বন্ধ করতে হবে। উপকূল রক্ষায় গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। উপকূলের কম্যুউনিটির মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

 

বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের বেসরকারি উপদেষ্টা এমএস সিদ্দিকি বলেন, মানুষই যদি না থাকে তাহলে উন্নয়ন দিয়ে কী করবো। মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। বাঁচাতে হবে নদী ও পরিবেশকে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ঠেকাতে সবাই একত্রে কাজ করতে হবে।

 

জাতীয় সংলাপে উপকূলীয় অঞ্চল থেকে আসা জলবায়ুর অভিঘাতে ভুক্তভোগীরা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, অনাবৃষ্টি, বর্জ্য থেকে পানিদূষণও ইলিশের অভয়াশ্রমের প্রবেশপথে নানা প্রকল্পে ভরাট হয়ে যাওয়ায় ভরা মৌসুমে ইলিশের দেখা না মেলার মূল কারণ। পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সংলগ্ন সমুদ্রে দীর্ঘ ডুবোচর, রাবনাবাদ, আগুনমুখা, আন্ধারমানিক এলাকায় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র হওয়ায় ইলিশের আনাগোনা কমে গেছে। কক্সবাজার সংলগ্ন নাফ নদী ও মাতারবাড়ি অঞ্চলে উপকূলীয় মৎস্য সম্পদ ও মৎসজীবীদের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে।

 

তারা বলেন, উপকূলের লবণ চাষের জন্য উল্ল্যেখযোগ্য কক্সবাজারের মহেশখালীতে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়াতে লবণ চাষিদের জমিতে লবণ পানি প্রবেশ করানো বন্ধ হয়ে গেছে। প্রকল্প কর্তৃপক্ষের বাধ দেওয়ার কারণে লবণ পানি প্রবেশ করিয়ে পানি শুকিয়ে লবণ উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। সেখানে এখন পানিও আসে না, আর তাই লবণ চাষও হয় না। যার ফলে লবণ চাষের ওপর নির্ভরশীল চাষিরা পড়েছেন জীবিকার সংকটে।