নিজস্ব প্রতিদেক:
ঢাকা: ‘ঈদকে কেন্দ্র করে একট জাল নোট প্রস্তুতকারী চক্রেরের লক্ষ্য ছিল বাজারে ৫০ লাখ টাকার জাল লোট ছড়িয়ে দেওয়ার। বিশেষ করে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ফতুল্লা, কুমিল্লা, শরীয়তপুর ও ফরিদপুরের বিভিন্ন জায়গায় জাল টাকা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রাথমিক পরিকল্পনা করেছিল।
গত ৭ থেকে ৮ দিন আগে ১২ থেকে ১৩ লাখ টাকা জালনোটের চালান বিক্রি করেছে। এই চালানে চক্রটি লাভ করেছে প্রায় দেড় লাখ টাকা। এছাড়া চক্রটি ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকার জাল নোট বিক্রি করেছিল। প্রস্তুতকারক চক্রটি প্রতি লাখ জাল নোটে লাভ করে ১০-১২ হাজার টাকা। চক্রটি দেড় বছর ধরে জাল টাকা তৈরি করে আসছিল। চক্রের মূলহোতা আরিফ বেপারী ইউটিউব ও বিভিন্ন কম্পিউটারের কোর্স করে শিখেছেন জালনোট তৈরির উপায়। সে কম্পিউটারের দোকানে কাজের আড়ালে জাল নোট ছাপানোর কাজ শুরু করে।
বুধবার (২৭ মার্চ) রাত দুইটার দিকে শরীয়তপুররের নড়িয়ার চরমোহন এলাকায় অভিযান চালিয়ে জাল টাকা প্রস্তুতকারী চক্রের মূলহোতা আরিফসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে র্র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। বাকি আসামিরা হলেন, অন্যতম প্রধান সহযোগী ও চক্রের সক্রিয় সদস্য মো. জাহিদ (২৩), ও অনিক (১৯)। এ সময় তাদের কাছ থেকে ২০ লাখ ৪৬ হাজার টাকা মূল্যমানের জালনোট, এর মধ্যে পাঁচশ টাকার জাল নোট ৯২টি এবং এক হাজার টাকার জাল নোট দুই হাজারটি ছাড়াও প্রিন্ট করা পাঁচশ টাকার বিপুল পরিমাণ নোট এবং জালটাকা তৈরিতে ব্যবহৃত একটি কালার প্রিন্টার, একটি ল্যাপটপ, একটি মাউস, একটি ল্যাপটপ চার্জার, দুইটি প্রিন্টারের ক্যাবল, একটি মাল্টিপ্লাগ, একটি স্টিলের স্কেল, একটি অ্যান্টিকাটার, একটি স্কিন প্রিন্টের ফ্রেম, একটি টাকা কাটার কাঁচ এবং দুটি মোবাইলফোন জব্দ করা হয়। ’বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ) বিকেলে তিনটার দিকে রাজধানীর কারওয়ানবাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র্যাব-৩ এর অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, আরিফ বেপারী এই জাল নোট ছাপানো চক্রের মূলহোতা। আরিফ আগে থেকেই কম্পিউটারে পারদর্শী ছিলেন। তিনি ঘড়িষাড় ইউনিয়নের বাংলা বাজারে একটি কম্পিউটার দোকানে কাজ করতেন। তিনি ইউটিউব থেকে জালটাকা বানানোর প্রক্রিয়া দেখে এবং নিজের অর্জিত কম্পিউটার দক্ষতা কাজে লাগিয়ে জাল নোট তৈরিতে পারদর্শিতা অর্জন করেন। পরে আরিফ তার অপর দুই সহযোগী জাহিদ এবং অনিকের সহযোগিতায় কম্পিউটার, প্রিন্টার এবং জালটাকা তৈরির কাঁচামাল সংগ্রহ করে নিজ গৃহে জালটাকা ছাপানোর কাজ শুরু করেন। গ্রেপ্তারকৃত আরিফ, জাহিদ ও অনিক বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে জাল টাকা বিক্রির জন্য নেটওয়ার্ক তৈরি করেন। তারা এসব পেজ প্রমোট ও বুস্টিং করে অনেক পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা সংগ্রহ করেন। এ চক্রটি বছরব্যাপী জাল নোট প্রস্তুত ও বিক্রয় করে এলেও ঈদুল ফিতরকে টার্গেট করে বিপুল পরিমাণ জাল নোট বাজারে সরবরাহ করার প্রস্তুতি নিয়েছিল। তারা প্রতি এক লাখ টাকা মূল্যমানের জাল নোট ১০ থেকে ১২ হাজার টাকায় বিক্রি করতেন। ঈদ উপলক্ষে জালনোটের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে তারা প্রতি এক লাখ টাকার জাল নোট ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করছিলেন মর্মে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেন।
আসামি আরিফ জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে র্যাব-৩ এর অধিনায়ক বলেন, শরীয়তপুরের অধিকাংশ লোকই ইতালি প্রবাসী এবং দেশে অবস্থানরত বড় একটি অংশ রাজধানীর বাংলা বাজারের বিভিন্ন প্রিন্টিং প্রেসে কর্মরত। পরিচিতদের সূত্র ধরে তিনি বিভিন্ন সময় রাজধানীর বাংলা বাজারে এসে অবস্থান করে প্রিন্টিং সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করেন। সে ধারণা থেকেই জাল টাকা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল যেমন রং, কালি ও কাগজ পুরান ঢাকা থেকে কিনতেন। এসব তৈরি করা জালনোটগুলো বিক্রির জন্য আরিফ, জাহিদ এবং অনিক মিলে ফেসবুকে জাল টাকা বিক্রির বিভিন্ন পেজ ও গ্রুপের (যেমন; এ গ্রেড জালনোট, টাকা চাই, জালনোট, জালটাকা বিক্রি করি, জাল টাকার ডিলার, জাল টাকা বিক্রয় কেন্দ্র, রিয়েল সেলস্, টাকা বিজনেস ইত্যাদি) পোস্টে জালটাকা ক্রয়ে আগ্রহী কমেন্টকারীদের সাথে ভুয়া আইডি খুলে ইনবক্সে যোগাযোগ করে। পরবর্তীতে তারা হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, ইমো প্রভৃতি অনলাইন যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে সরাসরি সাক্ষাতের মাধ্যমে জালটাকা ডেলিভারির কাজ করে থাকে। এ চক্রটি বিগত সময়ে জাল টাকার বড় ধরনের একাধিক চালান ডেলিভারি দিয়েছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়। চক্রটি ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, শরীয়তপুর ও ফরিদপুর এলাকায় জালনোট সরবরাহ করত বলে স্বীকার করে।
তিনি বলেন, আরিফ এইচএসসি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। তিনি পড়ালেখা বাদ দিয়ে শরীয়তপুরের নড়িয়ার বাংলাবাজারে একটি কম্পিউটারের দোকানে কাজ করতেন। দোকানের কাজ করে যে অর্থ উপার্জন করতেন সে টাকা জমিয়ে জালনোট ছাপানোর জন্য ল্যাপটপ, প্রিন্টার এবং প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় করেন। পরবর্তীতে তিনি তার নিজ গৃহে কম্পিউটারের দোকানে কাজের আড়ালে জাল নোট ছাপানোর কাজ শুরু করেন। তার জালনোট ছাপানোর কাজে অন্যতম সহযোগী হিসেবে জাহিদ এবং অনিক সহযোগিতা করতেন। তারা জালনোট বিক্রি করে যে টাকা পেতো তার অর্ধেক আরিফ নিতেন এবং বাকি অর্ধেক জাহিদ ও অনিক ভাগ করে নিতেন বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেন।
আসামি জাহিদ ও অনিকের বিষয়ে র্যাব-৩ এর অধিনায়ক জানান, জাহিদ নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। ২০২১ সালে সৌদি ফেরত জাহিদ পদ্মা নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিল বলে জানায়। কিন্তু তিনি অল্প পরিশ্রমে অধিক অর্থের আশায় মাছ ধরার আড়ালে, আরিফের সঙ্গে জালনোট ছাপানোর কাজ শুরু করেন। তিনি জালনোট বিক্রির জন্য বিভিন্ন অনলাইন গ্রুপে পোস্ট করে কাস্টমার সংগ্রহ করতেন। সেসব পোস্টে যারা কমেন্ট করতেন তাদের সঙ্গে ইনবক্সে যোগাযোগ করে জালনোট বিক্রির জন্য চুক্তি সম্পন্ন করতেন। চুক্তি সম্পন্নকারী ক্রেতার কাছে জালনোট সরবরাহের সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। এছাড়া আসামি অনিক পেশায় একজন রাজমিস্ত্রি। তিনি তার পেশার আড়ালে আরিফ ও জাহিদের সঙ্গে জালনোট ছাপানোর কাজে যোগ দেন। তিনি তৈরি করা জাল টাকা প্রিন্টিংয়ের পর সঠিক সাইজ অনুযায়ী কাটিংয়ের কাজ করতেন। পাশাপাশি ফোনে এবং অনলাইনে অর্ডার করা জাল টাকা বিভিন্ন জনের কাছে পৌঁছে দিতে ডেলিভারিম্যান হিসেবেও কাজ করতেন।
এক প্রশ্নের জবাবে র্যাব-৩ এর অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সাধারণ মানুষের দায়িত্ব। কোন জিনিসটা গ্রহণ করব আর গ্রহণ করবে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রলোভন দিলেই সেই প্রলোভনের ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অবৈধ প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে ওইসব পেজ বা গ্রুপকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সাইবার মনিটরিং টিম এ বিষয়ে অবশ্যই কার্যকরী ব্যবস্থা নেবে।