ই-পেপার | বৃহস্পতিবার , ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

কক্সবাজারে ফের অপহরণের শিকার ৫ কৃষক, উদ্বেগে সিভিল সোসাইটি

এইচএম ফরিদুল আলম শাহীন :

কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ও স্থানীয় সন্ত্রাসীরা মিলে মুক্তিপণের জন্য টার্গেট করে অপহরণ করছে। বাদ যাচ্ছেনা শিশু, কিশোর, যুবক ও বৃদ্ধ। ফলে চরম আতংক ছড়িয়ে পড়ছে জেলা জুড়ে। ছেলে মেয়েদের শিক্ষা প্রতিষ্টা নে যাতায়াতে দেখা দিয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা।

 

এখন পর্যন্ত অপহরণের শিকার ৭ জনের খোঁজ মিলেনি। যদি ও বা অপহরণের সাথে সংশ্লিষ্ট রোহিঙ্গা ও স্থানীয় ৮জন অপহনকারী সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করেন, পুলিশ ও র‍্যাব।

 

তবে স্থানীয়রা দাবি করছেন, গত বৃহস্পতিবার (২১ মার্চ) টেকনাফে একসাথে ৫ কৃষককে অপহরণ করে গহীন অরণ্যে নিয়ে গেছে রোহিঙ্গা ও স্থানীয় সন্ত্রাসীরা।

 

এ দিকে টেকনাফের হ্নীলার অপহ্নত মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ছোয়াদ বিন আবদুল্লাহ (৬), আর গত ৫ ফেব্রুয়ারী কক্সবাজার সদর থেকে অপহ্নত চকরিয়া ফাঁসিয়াখালী দারুল উলুম মাদ্রাসার ৭ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী রাশিকুল ইসলামকে একমাস ১৭ দিনে ও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

 

বৃহস্পতিবার (২১ মার্চ) ভোরে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের পশ্চিম পানখালী পাহাড়ী এলাকা থেকে সর্বশেষ পাঁচ কৃষককে অপহরণ করে রোহিঙ্গা ও স্থানীয় দুর্বৃত্তরা।

 

অপহৃতরা হলেন, টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের পশ্চিম পানখালী এলাকার মোহাম্মদ শাহজাহানের ছেলে মো. জিহান (১৩), একই এলাকার ফকির আহম্মদের ছেলে মো. রফিক (২২), আব্দু রকিমের ছেলে মোহাম্মদ নুর, মৃত মো. ছৈয়দুল্লাহর ছেলে মো. শামীম ও নুরুল আমিনের ছেলে আব্দুর রহমান। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন হ্নীলা ইউপি চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী।

 

টেকনাফ থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ ওসমান গণী জানান, ‘অপহ্নত দুই মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে এখনো অবশ্য উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এরমধ্যে পাঁচ কৃষক অপহরণের ঘটনা সম্পর্কে পুলিশ অবগত।তবে তাদের পরিবার থেকে এখনো লিখিত কোন অভিযোগ পাওয়া যায়নি।তারপর ও পুলিশ অপহ্নতদের উদ্ধারে জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে’।

 

অপহৃতদের স্বজনদের বরাতে রাশেদ মাহমুদ আলী বলেন, বুধবার (২১ মার্চ) রাতে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের পশ্চিম পানখালী পাহাড়ী এলাকা সংলগ্ন ফসলি খেত পাহারা দিচ্ছিল কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা। বৃহস্পতিবার (২২ মার্চ) ভোররাতের দিকে গহীন পাহাড়ের দিক মুখোশধারী একদল দুর্বৃত্ত অস্ত্রের মুখে ৫ জনকে তুলে নিয়ে যায়। পরে স্বজনরা বিষয়টি অন্যদের জানান।

 

অপহৃত জিহানের মা ফাতেমা বেগম জানান, ‘সকালে তার ছেলেসহ ৫ কৃষককে অপহরণের ঘটনা জানতে পারেন। পরে বিষয়টি স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানকে জানানো হয়। দুপুরের দিকে অজ্ঞাত পরিচয় এক ব্যক্তি মোবাইলে কল দিয়ে ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। তিনি বলেন, এর মধ্যে মোহাম্মদ নুরের স্বজনদের কাছে ১৫ লাখ টাকা এবং অন্য স্বজনদের কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা করে মুক্তিপণ দাবি করে ওই রোহিঙ্গা দুর্বৃত্তরা’।

এদিকে গত ৯ মার্চ টেকনাফ উপজেলার হ্নীলায় অপহৃত মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ছোয়াদ বিন আব্দুল্লাহ (৬) ১২ দিনেও উদ্ধার হয়নি। যদিও পুলিশ এই অপহরণে ব্যবহৃত অটোরিকশার চালক ও সংঘবদ্ধ চক্রের নারী সদস্যসহ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এ ঘটনায় জড়িত অন্য আসামিদের গ্রেপ্তার ও অপহৃত মাদ্রাসা ছাত্রকে উদ্ধারে পুলিশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানান ওসি ওসমান গনি।

 

এধরণের সিরিজ অপহরণের ঘটনা থামাতে কক্সবাজার সিভিল সোসাইটিজ ফোরামের জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয় গত ২১ মার্চ সকাল ১০ টায় শহরের পুরোনো শহীদ মিনারস্থ কার্যালয়ে।
এতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল কাদের চৌধুরী।

 

এতে বক্তব্য রাখেন অধ্যক্ষ একেএম ফজলুল করিম চৌধুরী, কক্সবাজার জেলা প্রেসক্লাবের সিনিয়র সহসভাপতি এইচএম ফরিদুল আলম শাহীন, বীর মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার কানন পাল, বীর মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী আবদুল মতিন, সাংবাদিক তৌহিদ বেলাল ও আরো অনেকে।

 

বক্তারা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের অপহরণ বানিজ্য, অস্ত্র, মাদকসহ নানা অপকর্মের ফলে স্থানীয়দের সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেন।শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিধানে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেন। আর স্থানীয়দের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করতে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনকে জনসচেতনতা মূলক কার্যক্রম গ্রহনে এগিয়ে আসার আহবান জানান।

 

উল্লেখ্য, গত ৫ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার সদর থেকে অপহৃত আরেক মাদ্রাসা শিক্ষার্থী রাশিকুল ইসলামকেও (১৫) উদ্ধার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে এ ঘটনার সাথে জড়িত ৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। মিয়ানমার সীমান্তের টেকনাফে গত এক বছরে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ১০৬ টি। তাদের মধ্যে ৪৬ জনকে ছাড়িয়ে আনতে হয়েছে মুক্তিপণ দিয়ে। কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের মার্চ থেকে ২০২৪ এর মার্চ নাগাদ টেকনাফে পাহাড়কেন্দ্রিক যে ১০৬টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে ৫৬ জন স্থানীয় এবং ৫০ জন রোহিঙ্গা।

 

এদিকে র‍্যাব ১৫ এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ আবু সালাম চৌধুরী জানান, গত ২ মার্চ রাতে উখিয়া উপজেলার থাইংখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে এ ঘটনায় তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়।এরা হলেন, ১২ নং ক্যাম্পের আলী হোসেনের ছেলে আবদুল্লাহ (৩৪), একই ক্যাম্পের মৃত আবুল খায়েরের ছেলে আমিন উল্লাহ (১৯)ও কক্সবাজার সদর উপজেলার ঝিলংজা ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ডের মহুরী পাড়ার নূর মোহাম্মদের ছেলে মোঃ তারেক (১৮)।

 

অপহরণের শিকার মাদ্রাসা ছাত্র রাশিকুল ইসলামের মা নাছিমা ইয়ামিন র‍্যাবের কাছে অভিযোগ করেন এবং বলেন, তার ছেলে ৫ ফেব্রুয়ারী মাদ্রাসা থেকে ছুটিতে বাড়ি আসে। একই দিন তার ছেলে নিখোঁজ হয়।এর পর গত ৭ ফেব্রুয়ারী একাধিক নাম্বার থেকে ফোন আসে। তারা বলেন, রাশিকুল অপহরণের শিকার হয়েছে। মুক্তিপণ হিসাবে দুই লক্ষ টাকা দিতে হবে। কথানুযায়ী দুই লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দেয়া হয়।

 

এরপর আরো দুই লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে চক্রটি। এ ব্যাপারে কক্সবাজার সদর থানায় গত ১০ ফেব্রুয়ারী সাধারণ ডায়রী করা হয়। ডায়রী নং ৭৬১। ধৃত অপহরণকারী র‍্যাবের কাছে দেয়া স্বীকারোক্তি অনুযায়ী একটি সিএনজি যোগে রাশিকুলকে টেকনাফ নিয়ে গিয়ে তাদের আরেক সদস্যের কাছে হস্তান্তর করে। সেই ৫ ফেব্রুয়ারী রাতেই অপহ্নতকে মিয়ানমারে পাচার করা হয়। সে এখন ও মিয়ানমারে জিম্মি রয়েছে। র‍্যাব কর্তৃক গ্রেফতার দুই রোহিঙ্গা ও এক স্থানীয়র বিরুদ্ধে ভিকটিমের মা বাদী হয়ে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় মামলা করেন। এখন পর্যন্ত ওই শিশুটি এখনো উদ্ধার হয়নি।