নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাংলাদেশ রেলওয়ের একজন কর্মকর্তার উদ্যোগ ও সংশ্লিষ্ট অন্যদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স প্রথম বর্ষ ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারলো প্রায় ৭০০ শিক্ষার্থী।
অথচ গত মঙ্গলবার রাজশাহীগামী ধূমকেতু এক্সপ্রেস ট্রেন যান্ত্রিক সমস্যায় পড়ে ঢাকা থেকে ছাড়তে তিন ঘণ্টা বিলম্ব হওয়ায় তাদের সবার পরীক্ষা ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়াটাই গভীর অনিশ্চয়তায় পড়ে গিয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত ওই কর্মকর্তার বিশেষ উদ্যোগ ও তার টিমের অন্যদের সহযোগিতার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের উৎসাহমূলক পদক্ষেপের সুবাদে নানা নাটকীয় ঘটনার মধ্যে পরীক্ষা শুরুর ২২ মিনিট আগেই ট্রেনটি ওই শিক্ষার্থীদের নিয়ে রাজশাহীতে পৌঁছাতে সক্ষম হয়।
এর জের ধরে গতকাল থেকেই সামাজিক মাধ্যমে প্রশংসায় ভাসছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার।
প্রশংসা করতে গিয়ে কেউ কেউ ভারতীয় ওয়েব সিরিজ ‘দ্য রেলওয়ে ম্যান’-এ ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনার সময় রেল কর্মকর্তাদের ভূমিকার কথাও উল্লেখ করছেন।
‘একটা ঝুঁকি নিয়েই ফেললাম। ওরা আমাদের সন্তান। আর গত বছর আমার সন্তানের ভর্তি পরীক্ষার সময় দৌড়াদৌড়ির অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল।’
‘আমার পুরো টিম দায়িত্ববোধ নিয়ে আগ্রহ সহকারে এই শিক্ষার্থীদের কথা ভেবেছে। ভিসি নিজেও অনেক সহানুভূতিশীল হয়ে আমাদের উৎসাহ দিয়েছেন। ট্রেনের অন্য যাত্রীরাও সহায়তা করেছে’, বিবিসি বাংলাকে বলেছেন তালুকদার।
ওই ট্রেনেই নিজের ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছিলেন ঢাকার দেবাশীষ ঘোষ। ঘোষ বিবিসি বাংলাকে বলেন, প্রথমে বিলম্ব ও অন্য কারণে তারা সবাই রেল কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বিরক্তি প্রকাশ করছিলেন।
‘কিন্তু এরপর তারা যা করল সেটি অবিশ্বাস্য। এমনকি একটি স্টেশনে বলা হল যে বাচ্চাদের পরীক্ষায় দেরি হয়ে যাবে বলে পরের স্টেশনে দাঁড়ানো যাবে না, তাই পরের স্টেশনের যাত্রীরা আগেই নামতে পারেন। এ ঘোষণার পর পরের স্টেশনের যাত্রীরা নি:শব্দে এক স্টেশন আগেই নেমে গেল। সব মিলিয়ে আসলেই অবিশ্বাস্য একটি ব্যাপার। রেল সত্যিই দারুণ কাজ করেছে’, বলছিলেন দেবাশীষ ঘোষ।
যা ঘটেছিল সেদিন মঙ্গলবার সকাল ছয়টায় রাজশাহীগামী ধূমকেতু এক্সপ্রেস ঢাকায় কমলাপুর স্টেশন ছাড়ার কথা থাকলেও যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে সেটা সম্ভব হয়নি।
ওই ট্রেনেই ছিলেন সাতশোর মতো শিক্ষার্থী যারা বিকেল চারটায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য যাচ্ছিলেন।
কিন্তু আগের দিন ওই ট্রেনে কিছু কাজ করা হয়েছিল, যার পর যাত্রার দিন ভোরে আর ট্রেনটির ইঞ্জিন চালু করা যাচ্ছিলো না। প্রকৌশলীরা আপ্রাণ চেষ্টা করে ৯টা নাগাদ ইঞ্জিন সচল করতে সক্ষম হন।
এর মধ্যে তিন ঘণ্টার বিলম্ব দেখে পরীক্ষার্থীরা অনেকে স্টেশনের গার্ডদের কাছে যায় এবং বেলা ৩টার মধ্যে তাদের রাজশাহী পৌঁছানো দরকার বলে জানায়।
‘গার্ড তাৎক্ষণিক এসে বিষয়টি আমাকে জানায়। আমি সাথে সাথে ঢাকা কন্ট্রোলকে কল দিলাম এবং বললাম এই ট্রেন পথে নির্ধারিত কোনো স্টেশনে আর কোথাও দাঁড়াবে না।’
‘এমনকি ক্রসিং পড়লে এ ট্রেন বন্ধ না করে উল্টো দিক থেকে আসা ট্রেনকে আগেই বন্ধ করে রাখতে হবে। এভাবেই এটা চলবে,’ বলছিলেন তালুকদার।
অবশেষে ট্রেনটি সোয়া নয়টায় ঢাকা ছেড়ে রওনা হল। ভেতরে উদ্বিগ্ন শত শত পরীক্ষার্থী আর বিভিন্ন স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়া অন্য যাত্রীরা।
ট্রেনটি জয়দেবপুর ছাড়ার পর পুরোপুরি পশ্চিমাঞ্চলের দায়িত্বে এলে তালুকদার আরো সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি সরাসরি যোগাযোগ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সাথে।
‘সব শুনে ভিবি বললেন, তিনি ছাত্রদের সুযোগ দেয়ার জন্য তার টিমের সাথে আলোচনা করবেন এখনই। আর আমাকে বললেন কিছুক্ষণ পরপর তাকে অগ্রগতি জানানোর কথা।’
এদিকে ট্রেন এগিয়ে চলছিল। কিন্তু সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া পৌঁছানোর পর সোয়া তিন ঘণ্টা বিলম্বে রওনা দেয়া ট্রেনটির ইঞ্জিন আবার বিকল হয়ে পড়ে।
তালুকদার-সহ অন্য কর্মকর্তারা তখন আশেপাশে কাছাকাছি কোথায় ভালো ইঞ্জিন আছে খুঁজতে শুরু করেন।
তালুকদার বলছিলেন, ‘ট্রেনের চাকাই জ্যাম হয়ে গিয়েছিলো, নড়ানোই যাচ্ছিল না। পরে ঈশ্বরদী থেকে অন্য একটি ট্রেনের ইঞ্জিন এগুতে বললাম। তবে দুটি ইঞ্জিন নিয়ে ওই লাইনে ব্রিজ থাকায় ট্রেন চালানো যায় না।’
এর মধ্যে কর্মকর্তারা হিসেব করে দেখেন যে ওই অবস্থায় নতুন ইঞ্জিন এনে সেটি জোড়া দিয়ে যাত্রা শুরু করে রাজশাহী পৌঁছালেও ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার সুযোগ পাবে না শিক্ষার্থীরা।
এর মধ্যে চিলাহাটি এক্সপ্রেস নামের আরেকটি ট্রেন উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিয়ে সেখানে পৌঁছালে মিস্টার তালুকদার সেই ট্রেনের ইঞ্জিন শিক্ষার্থীদের বহনকারী ধূমকেতু এক্সপ্রেসের সাথে সংযুক্ত করার নির্দেশ দেন।
সেটি করা হলো, কিন্তু এরপরও হিসেব করে দেখা গেলো রাজশাহীতে চারটার আগে পৌঁছানো কঠিন হবে।
তালুকদার আবার ভিসির সাথে যোগাযোগ করে অনুরোধ করলেন পরীক্ষা কিছুক্ষণ পিছিয়ে দেয়ার জন্য। ভিসিও সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং বললেন সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে।
‘এরপর আমরা আসলেই ঝুঁকিই নিলাম। গতি বাড়িয়ে দিতে বললাম ট্রেনের। যে গতিতে চালানো হয়েছে তার জন্য এই ট্রেনটি যথাযথ ছিলো না। তারপরও বাচ্চাদের জন্য এই ঝুঁকি আমরা নিলাম।’
‘পুরো ট্রেনে মাইকিং করে অন্য যাত্রীদের বললাম যে সবাইকে রাজশাহী নিয়ে আমাদের ব্যবস্থাপনায় যার যার স্টেশনে পাঠাব। তারা যেন সন্তানদের জন্য এটুকু স্যাক্রিফাইস করেন। তারাও সহায়তা করলেন,’ বলছিলেন তালুকদার।
পথে আরো যেসব স্টেশনে ট্রেনটির যাত্রী নামানোর কথা ছিলো সময় বাঁচাতে সে সব স্টেশনে আর দাঁড়ালো না ট্রেনটি।
এভাবে বিলম্ব আর নাটকীয়তাপূর্ণ ভ্রমণ শেষে বেলা তিনটা ৩৮ মিনিটে ট্রেনটি রাজশাহী পৌছায়। সেখানে নেমেই শিক্ষার্থী দ্রুত যার যার পরীক্ষা কেন্দ্রে যাওয়ার চেষ্টা করে।
‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দারুণ সহযোগিতা করেছেন। তাও কারো কারো ৫-১০ মিনিট দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা ঝুঁকিটা না নিলে ওদের পরীক্ষাই দেয়া হত না।’
“আমাদের টিমের প্রতিটি মানুষ গভীর আগ্রহ নিয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করেছে বলে এটা সম্ভব হয়েছে”, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন অসীম কুমার তালুকদার।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশংসা মঙ্গলবার পরীক্ষা শেষ হবার পর থেকেই সামাজিক মাধ্যমে অনেকে ঘটনাটি প্রকাশ করে পোস্ট দিতে থাকেন। কেউ কেউ তালুকদারের ছবি দিয়ে তার প্রশংসা করেও পোস্ট দেন।
মো: শহীদুল হাসান নামে একজন তার পোস্টে লেখেন, ‘ঢাকা থেকে আসা একটি ট্রেনের ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যায়। থ্যাংকফুলি পশ্চিমাঞ্চল ট্রেনের এই মহাব্যবস্থাপক সেটা মনিটর করছিলেন।’
‘নিজে রাবির ভিসি স্যারের সাথে কথা বলে পরীক্ষায় লেট এন্ট্রির ব্যবস্থা করেন এবং ওই নষ্ট ট্রেনের কাছাকাছি থাকা অন্য ট্রেনের ইঞ্জিন খুলে এটায় লাগিয়ে দ্রুত রাজশাহী পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছেন।’
‘এত কষ্ট না করে নাকে তেল দিয়ে ঘুমালেও কারও কিছু করার ছিল না। তবু একটু সহমর্মিতা দেখিয়েছেন বলে অন্তত ৭০০ স্টুডেন্টকে কাল চোখের পানি ফেলতে হয়নি। উনার নাম অসীম কুমার তালুকদার’, পোস্টে এভাবেই মন্তব্য করেছেন তিনি।
এইচ এম রানেল লিখেছেন, ‘৭০০ শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নিশ্চিত করলো অসীম কুমার! বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের জেনারেল ম্যানেজার অসীম কুমার তালুকদারকে নিয়ে একটি চমৎকার ওয়েবফিল্ম তৈরি হতে পারে।’
‘তৈরি হতে পারে ৫মার্চের অসংখ্য ছাত্রছাত্রীর নিশ্চিত মিস হয়ে পড়া ভর্তি পরীক্ষাটিতে অংশগ্রহণ করে ফেলার কাহিনী নিয়ে!’
এমন অসংখ্য পোস্টে সয়লাব এখন ফেসবুক, যেগুলো শেয়ার করেও অনেকে আবার তালুকদারসহ রেলওয়ের ভূয়সী প্রশংসা করছেন।