ই-পেপার | মঙ্গলবার , ৩রা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ফায়ার সার্ভিস কেন ডিজিটালাইজেশনের বাইরে?

মো. আরিফ উল্লাহ :

রাজধানীতে আগুন বা যে কোনো দুর্ঘটনার কথা শুনলেই অন্যান্য সংস্থা ও বাহিনীর মধ্যে সবার আগে যাদের স্মরণ করা হয় তারা হচ্ছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। এমন ঘটনায় যে দৃশ্যপটের অবতারণা হয় তা আর কারও কাছে অজানা নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘ঢাকা, অগ্নিকান্ড’ লিখে সার্চ দিলেই পাওয়া দৃশ্য হতে পারে এমন ‘বহুতল একটি ভবনে আগুনের শিখা, ভেতরে চিৎকার করছেন কয়েকজন, বাইরের লোকজন তাকিয়ে দেখছেন।’ পরের দৃশ্যে দেখা যাবে- ‘ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের গাড়ি আসে। শুরু হয় অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার তৎপরতা। ততক্ষণে কয়েকজন লোক অগ্নিদগ্ধ হয়ে কাতরাচ্ছেন।’

 

রাজধানীতে আগুন বা যে কোনো দুর্ঘটনায় সমন্বিতভাবে উদ্ধার তৎপরতা চালানোর ব্যবস্থা থাকা দরকার। এই ব্যবস্থাপনার মধ্যে থাকবে উৎসুক জনতাকে নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য সংস্থার নির্বিঘ্নে কাজ করার সুযোগ তৈরি। অগ্নিকাণ্ডসহ যে কোনো দুর্ঘটনায় মুহূর্তেই হাজারও জনতার ভিড় উদ্ধার তৎপরতায় সবচেয়ে বড় বাধা। সেখানে এখন যোগ হয়েছে লাইভ স্ট্রিমিংয়ের জন্য মোবাইল হাতে দাঁড়িয়ে ফুটেজ শিকারিরা। মানুষের ভিড়ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও ঠিক মতো চলতে পারে না। যা উদ্ধারকাজে বাধা তৈরি করে।

 

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডিজিটালাইজেশনের দিকে ছুটে চলেছে আমাদের বাংলাদেশ। আধুনিক চাহিদার কথা মাথায় রেখে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে একের পর এক মেগা প্রকল্প। কিন্তু দুর্ঘটনা মোকাবিলায় ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সকে কতখানি আধুনিকায়ন করা হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেল। প্রতিটি দুর্ঘটনা আমাদের প্রতিবার এই প্রশ্নটির মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। ভবন গড়ে উঠছে, বহুতল মার্কেট, শিল্প-কারখানা গড়ে উঠছে, কিন্তু নির্মাণকালেই দুর্ঘটনা মোকাবিলার ন্যূনতম ব্যবস্থা রাখার বিধান মানা হচ্ছে না। অবশ্য সম্প্রতি বেইলি রোডের ঘটনায় বহুতল ভবনের নিরাপত্তার বিষয়টি বেশ আলোচনায় এসেছে। কিন্তু এর আগে রাজধানীর পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকায় কেমিক্যাল গুদাম নিয়ে একসময় বেশ শোরগোল হয়েছিল, কিন্তু আবাসিক এলাকা ও ভবন থেকে আইন করেও সেসব গুদাম সরানো যায়নি। এবার আলোচনায় আছে রেস্টুরেন্ট।

কিছুদিন পর পর একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। কিন্তু প্রতিবারই আমাদের ভূমিকা নিতান্তই অসহায় মেছো বাঘের মতো, না পারি হুংকার দিতে, না পারি আত্মরক্ষা করতে। অগ্নিকান্ড বা অন্য কোনো দুর্ঘটনা মোকাবিলায় আমাদের ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সকে হিমশিম খেতে হয়। এই বাহিনীর আত্মত্যাগ ও কর্মদক্ষতা প্রশংসার দাবিদার। তবে তিক্ত হলেও সত্য যে, বড় আকারের দুর্ঘটনা মোকাবিলায় যে সব আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োজন তাতে আমাদের অনেক ঘাটতি রয়েছে।

 

প্রতি বছর হাজার হাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে চলেছে সেই সঙ্গে রাতারাতি পথে বসে যাচ্ছে হাজারো পরিবার, ভেঙে যাচ্ছে কয়েক যুগের লালিত স্বপ্ন, কেউ হারায় তার মা-বাবাকে, কেউ হারায় তার স্বামী, মা-বাবা হারায় তার সন্তান আর দেশ হারায় অমূল্য কিছু অমূল্য রতন। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেখা যায় ২০২৩ সালে মোট ২৭ হাজার ৬২৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে সে হিসেবে প্রতিদিন গড়ে ৭৭টি আগুনের ঘটনা ঘটেছে যেখানে ১০২ জন নিহত হয়, অপরদিকে ২০২২ সালে প্রায় ২৪ হাজার ১০২টি অগ্নিকান্ডের ঘটনার সাক্ষী হয় বাংলাদেশ। ২০২২ সালে অগ্নিকা-ে মোট ৯৮ জন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, যেখানে ১৩ জন ফায়ার সার্ভিসের বিভিন্ন স্তরের সদস্য রয়েছে। ২০২৩ সালে অগ্নিকা-ের ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮০০ কোটি। ২০০০ সাল থেকে জুন ২০২২ পর্যন্ত কমপক্ষে ২১টি অতি মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে যেখানে প্রায় ১৮২৬ জনের প্রাণহানি ঘটেছে।

 

আমাদের দেশে অগ্নিকাণ্ডের প্রধান কারণগুলো হলো- আগে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়া, বৈদ্যুতিক গোলযোগ, নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার, ভবন তৈরিতে আইন না মানা ও নকশায় পরিবর্তন বা ভবনের পরিবর্তিত ব্যবহার, গ্যাস ও অন্যান্য দাহ্য পদার্থ ব্যবহারের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করা, অনিরাপদ রান্নাঘর, সিগারেট ও মশার কয়েল ব্যবহারে অসতর্কতা, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকা ও থাকলেও প্রশিক্ষণের অভাবে ব্যবহার করতে না পারা, দুর্ঘটনাস্থল থেকে বের হওয়ার বিকল্প রাস্তা না থাকা ইত্যাদি। অন্যদিকে সরু রাস্তা, বাড়ির মালিক বা তত্ত্বাবধায়কের ভুল সিদ্ধান্ত বা গাফিলতি, আশপাশে জলাশয় বা পানির ব্যবস্থা না থাকার কথাও উল্লেখ করা যায়।

 

এই সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় এই খাতে বার্ষিক বরাদ্দে ঘাটতির কথা। সরকারের উচিত এই খাতে বাজেট বৃদ্ধি করা। ফায়ার স্টেশনের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি যথাযথ জনবল নিশ্চিত করা খুব প্রয়োজন। কমার্শিয়াল চিন্তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে, ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের নিয়ম মাফিক ইমারত নির্মাণ করতে হবে। নির্দিষ্ট সময় পর পর এলাকাভিত্তিক মনিটরিং সিস্টেম চালু করতে হবে। এছাড়াও শিল্প-কারখানা, শপিং কমপ্লেক্স বা বড় বড় মার্কেটের কর্মীদের অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিতে হবে, দাহ্য পদার্থ কীভাবে সংরক্ষণ করতে হয় সে বিষয়ে পরিপূর্ণ ধারণা দিতে হবে। বিশেষ করে অগ্নিপ্রতিরোধ পরিকল্পনা এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরিয়ে নেওয়ার কৌশল বিষয়ে ধারণা প্রদান করতে হবে।

উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশের ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সকে আধুনিক সরঞ্জামে সজ্জিত করে এই বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটার পর আমরা দেখি আমাদের পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ও উন্নয়ন করপোরেশনগুলো তাদের দায় এড়াতে বলে বেড়ায় উক্ত ভবন/মার্কেটটি অনেক আগেই ঝুঁকিপূর্ণ বলে নোটিস দেওয়া ছিল। কেবল নোটিস দিয়ে বসে থাকলে তো দুর্ঘটনা এড়ানো যাবে না। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর পদক্ষেপ গ্রহণেও সৃজনশীল হতে হবে। আর কিছু না হোক ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সামনে তারা বড় করে নোটিসটি টাঙিয়ে দিতে পারেন।

লেখক : আইনজীবী
[email protected]