ই-পেপার | শনিবার , ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের অনীহা !

মুহাম্মদ আমির হোছাইন 

মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্যে কয়েক শতাব্দী ধরে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বসবাস। সমুদ্র উপকূলবেষ্টিত রাখাইন রাজ্যে রাখাইন জনগোষ্ঠীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষ রোহিঙ্গা। যারা নিজেদের ভাষায় কথা বলে;যদিও মিয়ানমার সরকার দ্বারা তা অনুমোদিত নয়। নাফ নদীর ওপারে মিয়ানমার যেন স্বপ্নের দেশ, যেখানে রয়েছে নিজ ভিটেমাটি। বিগত চার দশক ধরে বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের আশ্রয়স্থল,এবং জাত রক্ষার কাজ করে চলছে ।

এরা পাশের দেশ মিয়ানমার থেকে রাষ্ট্রীয় নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। ১৯৭৭-৭৮ সালের ড্রাগন কিং (নাগা মিন) অভিযানের পর হাজার হাজার রোহিঙ্গাদের ঢল নেমে আসে।এসময়ে দুই লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর ঠাই হয় বাংলাদেশে। ১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানের শিকার হয়ে আরো ৫০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার সরকারের সেনাবাহিনী দ্বারা ধর্ষণ, হত্যার স্বীকার হয়ে নিষ্কৃতি পাওয়ার আশায় সামীন্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে পাড়ি জমায়।সর্বশেষ, ২০১৭ সালের আগস্টে তাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের পরিকল্পিত হামলা গণহত্যা চালানোর পর স্রোত নামে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে।

সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর আগমন ঘটে। ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকার একটি প্রত্যাবর্তন চুক্তি স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড.এ কে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন- মিয়ানমারের সামরিক সরকার জানিয়েছে যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করার জন্য তারা ঢাকা ও নেপিদোর মধ্যকার স্বাক্ষরিত পূর্ববর্তী সকল চুক্তি মেনে চলবে (২০ অক্টোবর, ২০২২বাসস)। সেই সময়ে মিয়ানমার সামরিক কর্তৃপক্ষ বেইজিংকে জানিয়েছে যে সত্যতা যাচাই করার পর, তারা বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে সম্মত হয়েছে।বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কবে শুরু হবে, দুই পক্ষ প্রত্যাবাসনের সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া বা প্রত্যাবাসন সম্পূর্ণ করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমার বিষয়ে একমত হয়নি।

এরপরো সক্রিয়ভাবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রচেষ্টা চালানো হয়, যা সফল হয়নি। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া এই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কবে শুরু হবে । এমন প্রশ্ন থেকেই যায় । কিন্তু চুক্তির বছর পরেও একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেয়নি মিয়ানমার। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের অনীহা ও ছলচাতুরীতে প্রত্যাবাসন কখন হয় তা কুয়াশাচ্ছন্ন। এরই মধ্যে গত ৬ বছরে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে রোহিঙ্গার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ লাখের বেশি।এ বছর মাসের (৫ মে) প্রত্যাবাসন ইস্যুতে রাখাইনের ‘পরিবেশ-পরিস্থিতি’ দেখতে মিয়ানমার গেছে ২০ রোহিঙ্গাসহ ২৭ জনের একটি প্রতিনিধি দল।কিন্তু দুর্ভাগ্য হলে সত্য যে, রোহিঙ্গাদের তাদের অধিকার নিয়ে স্বদেশ মিয়ানমার ফিরে যাওয়া আগেই দিতে হচ্ছে যাচাই-বাছাই পরীক্ষা হচ্ছে। তারপরও তারা ফিরতে চান স্বদেশে।

তবে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন মিয়ানমারের আন্তরিকতা কখনোই ছিল না। বিভিন্ন সময় নিরাপত্তা পরিষদ, আইসিজেসহ আন্তর্জাতিক নানা ফোরাম থেকে মনোযোগ সরাতে মিয়ানমার প্রত্যাবাসনের বিষয়টি সামনে আনে। অতীতের ধারাবাহিকতায় মিয়ানমারের সদিচ্ছা আছে কি-না, সেই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। ফলে মিয়ানমার এ মাসে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর যে প্রস্তাবটি দিয়েছে, সেটি ছলচাতুরী হতে পারে কি-না, সেটিও বিবেচনায় নিয়ে সতর্কভাবে এগোনোই সংগত হবে। আপাতদৃষ্টিতে বৈঠক বেশ ফলপ্রসূ বলেই মনে হয়েছিল।

সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় মোখায় বড় ধরনের তাণ্ডব চালিয়ে গেছে মিয়ানমারের রাখাইনে রাজ্যে,মোখার কারণে কতজনের মৃত্যু হয়েছে এবং কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, এ বিষয়ে তথ্য লুকোচুরি করছে মিয়ানমার সামরিক সরকার ।এসব খবর প্রকাশে দেশটির মিডিয়ার ওপরও ব্যাপক বিধিনিষেধ রয়েছে ।নিচু এলাকার রোহিঙ্গা গ্রাম ও আইডিপি ক্যাম্পে অরক্ষতি রেখেছে সরকার ঘূর্ণিঝড় ,জলোচ্ছ্বাসে বারবার ক্ষতির স্বীকার হয়ে আসছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী।

মোখার তাণ্ডবের পর রোহিঙ্গাদের আদি নিবাস রাখাইনে মোখার আঘাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর অগে হঠাৎ করে গত ৫ মে বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রতিনিধিদল এবং প্রত্যাবাসনের প্রথম ব্যাচের অন্তর্ভুক্ত ২০ জন রোহিঙ্গা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু সফর করেন। মোখার তাণ্ডবের পর থেমে যায় ।এবস্থাতায় মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত কিংবা পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার মধ্যে মোট শিশুর সংখ্যা এখন প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ।

২০১৭ সালের আগস্টের পর থেকে গত পাঁচ বছরে টেকনাফ উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে জন্মলাভ করেছে দুই লাখেরও বেশি শিশু। জাতিসংঘ শরাণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর, ইউনিসেফ ও সেভ দ্য চিলড্রেনের পরিসংখ্যান জানায়, বর্তমানে প্রতিদিন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যুক্ত হচ্ছে গড়ে ৯০ শিশু। ফলে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা বেড়ে বর্তমানে সাড়ে ১৪ লাখে দাঁড়িয়েছে।শুধু তা-ই নয়, তাদের মধ্যে একাধিক বিয়ে ছাড়াও বাল্যবিয়ের প্রবণতা বাড়ছে।বিভিন্ন সংস্থা থেকে অধিক সন্তান জন্মদানবিরোধী নানা প্রচার-প্রচারণা চললেও বস্তুত সেটি ফলপ্রসূ হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোহিঙ্গারা এভাবে সন্তান জন্ম দিতে থাকলে একদিন টেকনাফ-উখিয়াসহ কক্সবাজারজুড়ে স্থানীয় অধিবাসীরাই সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে; পাল্টে যাবে সেখানকার জনমিতি।

মিয়ানমার সরকারকে তাদের অভ্যন্তরীণ অনেকগুলো রাজ্যেই বিদ্রোহী নানা গোষ্ঠীর সংঘাতের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। মিয়ানমার সরকার কতৃক বিদ্রোহী গোষ্ঠীর উপর বিমান হামলা পর্যন্ত চালানো হয়েছে ।গত বছরের ২২শে ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে। সেই প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোটো দেয়নি চীন বা রাশিয়া। বিশ্লেষকদের মতে বলছেন, চীনের এই ভূমিকার পেছনে একটাই কারণ, ভূ-রাজনৈতিক।মিয়ানমারের সঙ্গে বরাবরই চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। অতীতে জাতিসংঘে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে যেসব প্রস্তাব আনা হয়েছিল, তাতে বরাবর ভেটো দিয়েছে চীন।

কারণ চীন সবসময় চেয়েছে, মিয়ানমারে যেন চীনের বন্ধুভাবাপন্ন একটি সরকার ক্ষমতায় থাকে। কক্সবাজারের থাকা উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। ইয়াবা পাচার, ডাকাতি, চুরি ও মুক্তিপণ আদায় হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা।

বিপুলসংখ্যক মানুষের বাড়তি দায়িত্ব বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই বড় বোঝা দাড়াচ্ছে। কক্সবাজারের দীর্ঘস্থায়ী শান্তি, স্থিতি এবং নিরাপত্তার জন্য রোহিঙ্গা ইস্যুর রাজনৈতিক সমাধান অপরিহার্য। প্রত্যাবাসন না হওয়ায় মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে,সীমান্তে সংঘাতের শঙ্কা বাড়ছে, বাড়ছে আঞ্চলিক সংকটও।

বৈশ্বিক অস্থিরতা কিংবা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যাকে পুঁজি করে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করার কোনো সুযোগ নেই।তাই চীনসহ সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে ,তাদের সঙ্গে কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় মিয়ানমারের ওপর জোরালো চাপ রাখতে অব্যাহত রাখতে হবে । রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসনে সহেযাগিতা ও বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক ফল নিয়ে আসতে পারে ।

 

এইচ এম কাদের,সিএনএন বাংলা২৪: