বিশেষ প্রতিবেদক :
রোহিঙ্গা অধ্যুষিত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির চলমান তুমুল লড়াই ও গোলাগুলির শব্দে বাংলাদেশের বান্দরবান জেলার সীমান্তবর্তী বাসিন্দারা আতঙ্কে নিরাপদে সরে যাচ্ছেন। সোমবার স্থানীয় প্রশাসন সীমান্ত এলাকার আটটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একদিনের জন্য ছুটি ঘোষণা করে।
এই প্রেক্ষাপটে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যসংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
সোমবার সারাদিন শত শত রাউন্ড গুলি ও বোমার শব্দ শুনতে পান সেখানকার বাসিন্দারা। এর মধ্যে একটি মর্টার শেল নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রুর পশ্চিমকূল এলাকায় বসবাসকারী বাহাদুল্লাহর বাড়ির উঠানে গিয়ে পড়ে।
এ বিষয়ে বাহাদুল্লাহ স্ত্রীর খালেদা বেগম সাংবাদিকদের বলেন, “ঘরের দরজায় বসে মুঠোফোন কথা বলার সময় বাড়িতে গাছের সাথে গুলি লাগলে একটা বিকট শব্দ পাওয়া যায়। তবে এতে ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।”
সীমান্তে গোলাগুলির ব্যাপক শব্দের কারণে নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু এলাকার মাদ্রাসাসহ আটটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটি দেওয়া হয়েছে বলে জানান নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকারিয়া।
তিনি বলেন, “অন্যদিনের তুলনায় সোমবার ব্যাপক গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যায়। ভয়ে সীমান্তে বসবাসকারী কোনাপাড়া ও চাকমা পাড়ার শিশু-নারীসহ বেশকিছু লোকজন নিরাপদে স্বজনদের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। সীমান্তে জনপ্রতিনিধিদের সর্তক থাকতে বলা হয়েছে।
আমরা এলাকাবাসীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। কোনাপাড়া ও চাকমাপাড়া থেকে কত পরিবার নিরাপদে চলে গেছে তা এই পরিস্থিতির মধ্যে জানা সম্ভব হয়নি বলে জানান ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য শফিকুল ইসলাম।
তুমব্রু সীমান্তের বাসিন্দারা বলছেন, সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তুমব্রু সীমান্তের ঘুমধুমের বাজার পাড়ায়, বাইশ ফাঁড়িসহ তুমব্রু রাইটে ব্যাপক গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে।
জান্তার লড়াই করার সামর্থ্য নেই: আরাকান আর্মি
সংবাদমাধ্যম ইরাবতীর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরাকান আর্মি রোববার রাখাইনের মিনবিয়া শহরে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ৩৮০ ব্যাটালিয়নের সদর দপ্তর দখল করেছে।
ইরাবতীর তথ্যমতে, রাখাইনের ম্রাউক ইউ, কিউকটা ও রাথেডং এলাকায় দুই পক্ষের লড়াই চলছে।এদিকে আরাকান আর্মির বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে জান্তার লড়াই করার সামর্থ্য নেই। তারা এখন আরও বেশি গোলা নিক্ষেপ ও আকাশ থেকে বোমা হামলা চালাচ্ছে। সোমবার সকালে উখিয়া-টেকনাফের সীমান্তে মিয়ানমারের ওপারে সীমান্তের কাছাকাছি হেলিকপ্টার উড়তে দেখেছেন স্থানীয়রা।
সীমান্তে সতর্ক অবস্থায় বিজিবি:
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, গত কয়েকদিন থেকে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে সরকারি বাহিনীর সাথে আরাকান আর্মির তুমুল সংঘাত চলছে। বাংলাদেশ সীমান্তের একদিকে আরাকান আর্মি এবং আরেক দিকে সরকারি বাহিনী। তারা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশের নাগরিকেরা আতঙ্কিত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। “এই পরিস্থিতিতে জনগণকে আশ্বস্ত করতে আমরা বিজিবি-কে সীমান্তে সতর্ক অবস্থায় রেখেছি। তাদের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য হলো, কেউ যেন আমাদের সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে প্রবেশ করতে না পারে।”
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা মিয়ানমার সরকারের সাথে যোগাযোগ রাখছি। আমরা আশা করি, বাংলাদেশ ভূখণ্ডে আর কোনো মর্টার শেল পড়বে না।”মিয়ানমার সীমান্তে উদ্ভূত যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন সংস্থাটির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম নাজমুল হাসান। গত রোববার কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলায় বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত পরিদর্শন শেষে তিনি এ নির্দেশনা দেন।
রোহিঙ্গা শিবিরে নজরদারি বৃদ্ধি:
মিয়ানমারে সহিংসতার কারণে যাতে কেউ বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে না পারে সেজন্য কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে নজরদারি ও টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ৮-এপিবিএনের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আমির জাফর।
তিনি বলেন, “মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সহিংসতার কারণে বাংলাদেশে নতুন কোনো রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঢুকতে না পারে, সেজন্য চেকপোস্টসহ ক্যাম্পে কঠোর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।” নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রোহিঙ্গা নেতা বলেন, “মিয়ানমার সেদেশের ইন্টারনেট ও নেটওর্য়াক বন্ধ করে দিয়েছে। সেজন্য আমরা সেখানে থাকা রোহিঙ্গাদের খোঁজখবর পাচ্ছি না।”
আরকান রোহিঙ্গা আরকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মুহাম্মদ জোবায়ের বলেন, “রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন আরকান আর্মির সদস্যরা রোহিঙ্গা গ্রামে ঢুকে পড়েছে। একারণে জান্তা সরকার হেলিকপ্টার ও যুদ্ধবিমান দিয়ে সেখানে হামলা চালাচ্ছে। এতে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পুড়ে যাচ্ছে। হতাহতের খবর পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু আমরা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশে নিরুৎসাহিত করছি।”
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের বিদ্রোহী আরাকান আর্মি বার্মার শাসনে থাকতে চায় না। তারা রাখাইন রাজ্যকে স্বীকার করে না। বিদ্রোহী গোষ্ঠী এই রাজ্যকে আরাকান বলে মনে করে। তাদের মতে, আরাকান একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল। বার্মার রাজা আরাকান দখল করে রাজ্যটিকে দেশটির অন্তর্ভুক্ত করে।
আরাকানের স্বাধীন সত্ত্বা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে সশস্ত্র সংগ্রাম করে যাচ্ছে আরাকান আর্মি। সম্প্রতি তারা দখল করে নিয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা পালতোয়া, যেটি মিয়ানমারের চিন রাজ্যে অবস্থিত। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে পালতোয়ার দূরত্ব প্রায় ১৮ কিলোমিটার।