ই-পেপার | শুক্রবার , ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

হারিয়ে যাওয়া মসজিদ কেন্দ্রিক ‘মক্তব’ শিক্ষার উত্তরণ চাই!

শিব্বির আহমদ রানাঃ

পবিত্র কোরআনে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর হচ্ছে মক্তব। একইভাবে ধর্মীয় জ্ঞান লাভে মক্তব হচ্ছে মুসলমানদের প্রথম এবং আদি পাঠশালা। মধ্যযুগে মুসলিম বিশ্বে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে মক্তব বলা হত। উচ্চশিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত মাদরাসার মত মক্তবগুলোও মসজিদের সাথে সংযুক্ত থাকত। মক্তবের ব্যয় নির্বাহের জন্য উপমহাদেশে সুলতানি ও মুঘল শাসনামলে লাখেরাজ সম্পদের ব্যবস্থা করা হত। প্রাচীনকাল থেকে মসজিদ কেন্দ্রিক চলে আসছে মক্তব শিক্ষার এই কার্যধারা। ইসলামী শিক্ষা ছাড়া অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পূর্ণতা পায় না। একজন মুসলিম হিসেবে, মুসলমান ঘরের সন্তান হিসেবে প্রাথমিকভাবে ইসলামের শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। কেন না, ইসলাম একমাত্র আল্লাহ প্রদত্ত মনোনীত এক পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থার নাম। ইংরেজীতে বলা হয় ‘Islam is complete code of life.’

 

শিশুর শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক গুণাবলীয় উন্নয়নই শিক্ষার উদ্দ্যেশ্য। মক্তব সেই শিক্ষারই গোড়াপত্তন করে শিশুমনে। পারিবারিক শিক্ষার পাশাপাশি কোরআন শিক্ষার এই পাঠস্থান শিশুদের নৈতিকভাবে গড়ে উঠতে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। আপনার, আমার শিশুকে মক্তবে না পাঠালে তারা দ্বীনের প্রাথমিক ও মৌলিক শিক্ষা অর্জন থেকে বঞ্চিত হবে। এতে করে সে জানবে না ইসলামের মৌলিক ইবাদত নামায কিভাবে আদায় করতে হবে, কিভাবে সূরা-ক্বেরাত শুদ্ধ করে পড়তে হবে, কিভাবে হজ্ব, যাকাত, সাওম প্রতিপালন করতে হবে, কিভাবে মৃতের দাফন -কাপন ও জানাযা পড়তে হবে। ধর্মীয় জ্ঞান না থাকলে সে জানবে না হালাল, হারাম নির্ণয়ের সঠিক পন্থা।

 

অথচ দিন দিন এ সমাজ-দেশ থেকে মক্তব শিক্ষা হারিয়ে যেতে বসেছে। নাগরিক জীবনের নানাধরণের সমস্যা, ব্যস্ততা আর শিশুশিক্ষার বহুমুখিতার ফলে মক্তবের প্রয়োজনীয়তা আমাদের কাছে গৌণ হয়ে পড়ায় ভোরবেলায় শিশুদের মক্তবে যাওয়ার সেই চিরাচরিত দৃশ্য এখন গ্রামবাংলায় খুব একটা চোখে পড়ে না।

 

তাছাড়া বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ইসলামের এ মৌলিক শিক্ষা চর্চার ব্যবস্থা নেই। সকাল থেকেই ব্যাগবর্তি বই বোঝাই করে আমাদের কোমলমতিরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছুটে যায়। সেখানে আগডুম-বাঘডুম, হাট্টিমাটিমটিম, আয় আয় চাঁদ মামা দিয়ে দিনের প্রথমভাগ শুরু করে। শেষ হয় এভাবে রাত্রিটাও।

 

কিন্ডারগার্টেন কিংবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সকাল সকাল পাঠদান ব্যবস্থা থাকায় কোমলমতিরা ভোরে গিয়ে মক্তবে কোরান শিক্ষাগ্রহণ থেকে মারাত্মকভাবে বঞ্চিত হচ্ছে। যার দরুণ দ্বীনের শিক্ষা থেকে ধীরে ধীরে বিমুখ হচ্ছে মুসলিম জাতীর বিশাল একটি অংশ। অথচ দ্বীনি শিক্ষা অর্জন করা ফরজ। আমরা কোরআনের বাণী ভুলে গেছি। বলা হয়েছে- ‘যিনি কোরআন শেখায় তিনিই উত্তম শিক্ষক।’ এ উত্তম শিক্ষার প্রাথমিক সেন্টার মক্তব আজ বিলুপ্তির পথে। এ দায় আমরা কিছুতেই এড়াতে পারি না।

 

একটা সময় মসজিদের বারান্দাগুলো কিংবা তার পাশে স্থাপিত মক্তব খানায় দুরুদ শরিফ, হামদ-নাত আর আলিফ-বা-তা’র মিষ্টি মধুর সুরের শব্দে মুখরিত হতো। এখন শোনা যায় না সে চিরায়ত শব্দগুলো, শত কণ্ঠে সকাল বেলায় কোরআনের আওয়াজও। মক্তবে পড়ুয়া শিশুরা পথচারী তথা বড়দের দেখলে সালাম দেওয়া, বাড়িতে এসে সালাম দেওয়া, সালামের রীতি আর বড় হয়ে ভদ্র-নম্র এবং নীতিবান হওয়ার শুরুর শিক্ষা এ মক্তব থেকেই।

 

প্রতিটি মহল্লায় গড়ে স্বগৌরবে গড়ে উঠুক মক্তব ও নুরানী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এখানে পাড়া মহল্লার সচেতন বিবেকদের এগিয়ে আসতে হবে। মসজিদ পরিচালনা কমিটি ও শিক্ষিত জনগোষ্টির ভুমিকা চাই সবার আগে সবসময়। কোরআন, হাদিস শিক্ষা (অন্তত মৌলিক ইসলামিক জ্ঞানার্জন) শেষে বিকল্প শিক্ষায় শিক্ষিত হোক আমাদের প্রজন্ম এতে কোন দ্বিমত থাকার কথা নয়। তবে, গভীরভাবে চিন্তা করলে বিষয়টি এমন যে; খুব সকাল সকাল কিন্ডার গার্ডেন, আনন্দ ইশকুল, হাতেকড়ির শিক্ষার পাঠদান ব্যবস্থা মক্তব শিক্ষাকে বাধাগ্রস্থ করছে। তাই বিকল্প শিক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে সাথে সাথে দ্বীনি শিক্ষার আধুনিক মননে ‘নুরানী শিক্ষা/মক্তব শিক্ষা’ ব্যবস্থার উত্তরণ চাই।

 

লেখক-
শিব্বির আহমদ রানা, সংবাদকর্মী ও লেখক।

 

এইচ এম কাদের,সিএনএন বাংলা২৪