ই-পেপার | শনিবার , ২৯শে জুন, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

মেজর খালেদ, বর্ণাঢ্য এক সংগ্রামী কিংবদন্তি

@ফাহমিদা ইয়াসমিন@

বাংলার কৃতি সন্তান ইঞ্জিনিয়ার মেজর (অবঃ) খালিদুর রহমানের (মেজর খালেদ) মৃত্যুতে বর্ণাঢ্য এক সংগ্রামী কিংবদন্তির জীবনের অবসান হলো।

মৌলভীবাজার সদর উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত প্রথম চেয়ারম্যান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার (বুয়েট) কোরের অবসরপ্রাপ্ত মেজর, বাহারমর্দান নিবাসী খালিদুর রহমান সোমবার (১১ সেপ্টেম্বর) সকাল ৭টা ২০ মিনিটের সময় সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন, (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

 

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সাবেক প্রধান, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও পরমাণু বিজ্ঞানী ডক্টর খলিলুর রহমানের একমাত্র ছোট ভাই ইঞ্জিনিয়ার মেজর খালিদুর রহমান ইহজগৎ ত্যাগ করে পরজগতের স্থায়ী বাসিন্দা হলেন।

 

সবাইকে একদিন চলে যেতে হবে এই দুনিয়ার মায়া মোহ ছেড়ে। এই চিরন্তন সত্য কারো অজানা নয়। তবুও কারও কারও চলে যাওয়া আমাদেরকে এতোটাই কষ্ট দেয়, নির্ঘুম রাখে যেটা কল্পনার বাইরে। তিনিও তেমনি একজন। আমাদের পরিবারের একান্ত স্বজন ও সুজন। সম্পর্কে তিনি আমার মামাশ্বশুর, আমার শাশুড়ির ছোট ভাই।

 

মেজর খালেদ ছিলেন একজন জ্ঞানী এবং গুণী লোক। অধিকাংশ কাজের শুরুতে আমরা তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ নিতাম। বলা চলে, তিনি ছিলেন সুপরামর্শদাতা, আমাদের পরিবারের একান্ত স্বজন।

মধ্যবয়সী দু’টি ছেলে, একটি কন্যাশিশু ও স্ত্রীকে হারিয়েছেন অনেক আগেই। শেষে বড় সন্তানও চলে গেলো। এতো শোক, তবুও প্রচন্ড মনোবল ছিলো তাঁর।

 

মৌলভীবাজার শহরে ও শহরের বাইরে তাঁর অসংখ্য কাজ মনে রাখার মতো। যেসব কাজের জন্য মৌলভীবাজার জেলাবাসী তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।

জীবদ্দশায় তিনি মৌলভীবাজারের মানুষের সুখ-দুঃখ নিয়ে যেভাবে চিন্তা করতেন, তা কম মানুষের মধ্যে দেখতে পাই। মানুষ বাঁচে তার কর্মে- এই সত্যবাণীটি নিশ্চয়ই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে।

 

সৎ, সাহসী, পরিশ্রমী, নির্লোভ, পরোপকারী, নিরহংকারী এই শব্দগুলো তাঁর মতো মানুষের জন্য ব্যবহার করলে একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না। অথবা লোক দেখানো কিংবা মানুষের বাহবা পাওয়ার জন্যও নয়, যা সত্য ও যথোপযুক্ত তাই বলছি।

 

কিছুদিন আগে তাঁর একমাত্র জীবিত উত্তরাধিকারী মেয়ে মীমকে বিয়ে দিলেন। বিয়ে সম্পন্ন হলো মৌলভীবাজারের রাঙ্গাউটি রিসোর্টে। এই রাঙ্গাউটি রিসোর্টের জায়গাটুকু একসময় মৌলভীবাজারবাসী চিনতো ‘মেজর খালেদের’ ফিশারি নামে।

 

মৌলভীবাজার শহরের তীরে মনু নদীটি পাহাড় থেকে উৎপত্তি হওয়াতে অত্যন্ত খরস্রোতা। সেই নদীটির সংস্কারের কাজে ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে প্রধান দায়িত্বেও তিনি ছিলেন। এখানেও তিনি কাজে তাঁর সততার পরিচয় দিয়েছিলেন।

 

একসময় মনু ব্যারেজ বা স্লুইস গেট ছিলো মৌলভীবাজারবাসীর জন্য অলিখিত পার্ক। শহরের কোলাহল ছেড়ে মুক্ত বাতাসে বিকেল কিংবা সন্ধ্যা কাটানোর অন্যতম স্হান।আনমনা বিকেলের “রাঙ্গাউটি রিসোর্ট“ অথবা “মনু ব্যারেজ তথা স্লুইস গেট“ হয়তো বা খুঁজবে মেজর খালেদের ঘামের গন্ধ।

 

উল্লেখ্য, মেজর (অবঃ) খালিদুর রহমান ১৯৫৯ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৬১ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন ১৯৬৫ সালে। বুয়েট নামকরণ তখনো হয়নি। পরবর্তীতে পাকিস্তান মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে যোগদান করেন তিনি।

 

পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রাস্তার নাম কারাকোরাম হাইওয়ে। (এই কথাগুলো তাঁর কাছে বসে শোনা আমাদের)। অত্যন্ত সাহসী ছিলেন তিনি। রাস্তাটি পাকিস্তান থেকে চীনের উইঘুর জিনজিয়াং প্রদেশে গিয়েছে। পর্বতের উপর দিয়ে নির্মিত এই রাস্তাটির সর্বোচ্চ উচ্চতা ১৫ হাজার ফুট। অনেকে এই রাস্তাটিকে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য বলেন।

 

সেই রাস্তা নির্মাণে ইঞ্জিনিয়ারদের একজন ছিলেন মেজর খালেদ। তাঁর এই অবদানের জন্য সেই রাস্তার একটি ব্রিজের নামকরণ হয়েছে ক্যাপ্টেন খালেদ ব্রিজ। তখন তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেন ছিলেন।

(অনুলিখনঃ স’লিপক)
ফাহমিদা ইয়াসমিন: কবি, বৃটেন প্রবাসী।