ডা. আবদুন নূর তুষার
ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়বার সময় আমার মা আমাকে সপ্তাহে ১০০ টাকা দিতেন যাতায়াত ভাতা, আর ৫০০ টাকা দিতেন মাসে অন্যান্য খরচের জন্য। সবমিলিয়ে ৯০০ টাকা। আমার সারা মাসে যাতায়াতের টাকা লাগতো ৩০০ টাকা।সরাসরি মিনিবাসে চানখারপুল বা বখশিবাজার যেতে আসতে মিরপুর থেকে দিনে ১০ টাকা। মুড়ির টিন (বড় বাস) চড়লে ৬ টাকা , ছাত্র আইডি কার্ড দেখালে হাফ ভাড়া, ৩ টাকা। তাই প্রতিবার মাসের শেষ সপ্তাহের শুরুতে ১০০ টাকা পেলেই আমি চলে যেতাম নিউ মার্কেট। হেঁটে যেতাম, যাতে পয়সা বাঁচে, আর জমানো পুরো টাকা দিয়ে বই কিনতাম।
একবার সেরকম বই কিনে পকেটে আছে ১২ টাকা। রিকশা দিয়ে বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম। তখন ২য় বর্ষে পড়ি। রিকশাওয়ালা অতিরিক্ত ভাড়া চাইতে থাকায় আমি হেঁটে কলাবাগান চলে আসলাম। কলাবাগান থেকে আমার বাসার রিকশা ভাড়া ছিল আট টাকা। কেন যেনো কোন রিকশা সেদিন আর যেতে রাজি হয় না।
আমি রাগ করে হেঁটে চলে এলাম আসাদ গেট। এবার একজন রাজি হলো যেতে, কিন্তু ভাড়া তখনো বেশি। পকেটের ১২ টাকাই সে চায়। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম হেঁটেই বাড়ি ফিরবো।
ঠিক কলেজ গেট আর শ্যামলীর সংযোগস্থলে আসতেই দেখি রাস্তায় দাঁড়িয়ে এক দিনমজুর কাঁদছেন আর বলছেন,
“আল্লাহ তোমার দুনিয়ায় কি কেউ নাই, আমাকে একবেলা ভাত খাওয়ায়।”
আমি তার সাথে কথা বলে মনে হলো তিনি সত্যি কথা বলছেন। সকালে এসেছিলেন তুরাগ নদীর ওপার থেকে বসিলা হয়ে। দেরি হয়ে যাওয়ায় কাজ পাননি। কাঁদতে কাঁদতে বললেন
“আজকে না খেলে তো কালকেও কাজ করতে পারবো না।”উল্টোদিকের হোটেলে তাকে নিয়ে যেতে তিনি বললেন, কই মাছ দিয়ে ভাত খাবেন। হোটেলওয়ালা বললো, ভাত আর কই মাছ ১২ টাকা দাম। পকেটের সব টাকা দিয়ে তাকে ভাত আর কই মাছ খাওয়ালাম। তিনি হাততুলে আমাকে দুআ করলেন, আমার স্পষ্ট মনে আছে।
“আল্লাহ,আমার ভাইটার জীবনে যেন কোনোদিন ভাতের অভাব না হয়।”আমি বাকি রাস্তা হেঁটে মিরপুরে আমার বাড়িতে ফিরলাম।আমার পকেটে বহুদিন টাকা ফুরিয়ে গেছে, যখন এভাবে বই বা খেলনা কিনেছি! এমনকি বিদেশেও একবার এমন হয়েছিল। পকেটে টাকা নেই। থাকতে হবে আরো দুই দিন। খিদে লাগার সাথে সাথেই কেউ না কেউ আমাকে খাবার সেধেছে। আমার জীবনে এখনো ভাতের অভাব হয়নি।
সেদিন কেনো এতোটা পথ হেঁটেছিলাম?এখন বুঝি , আমি স্বেচছায় হাঁটিনি। সেই দিনমজুরের দুআ কবুল হয়েছিল। আমি হেঁটেছিলাম, কারণ আল্লাহ সেদিন আমার মাধ্যমে তাকে ভাত পাঠিয়েছিলেন।তাকে আরেকবার খুঁজে পেলে আমার জন্য দুআ করতে বলতাম।বলতাম, আল্লাহকে বলেন ভাই“আমার ভাইটা যেনো প্রিয় মানুষের ভালবাসার মধ্যে মরতে পারে। ”