ই-পেপার | শুক্রবার , ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ময়মনসিংহে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান না করার অনুরোধ আলেম ও মুসল্লিদের

প্রতিবেদক: মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ময়মনসিংহ:

ময়মনসিংহ সদর উপজেলা পরানগঞ্জে আলেম সমাজ ও মুসল্লিরা জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, এবার পহেলা বৈশাখের প্রোগ্রাম না করার অনুরোধ। পরিস্থিতির কারণে আমাদের বড় বড় অশ্লীল গান বাজনা থেকে এড়িয়ে চলতে হবে।

 

যতদিন যাচ্ছে তত পহেলা বৈশাখ তথা বর্ষবরণে এমন কিছু রেওয়াজজুড়ে যাচ্ছে যা মুসলমানের মূল স্প্রিটের সঙ্গে যায় না। প্রশ্ন উঠতে পারে, প্রায় ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান কেন ইসলামের স্প্রিটের বিরোধী হবে।

 

এর জবাব খুঁজতে হলে পহেলা বৈশাখের উৎপত্তি, বাংলার গ্রামীণ সমাজে প্রাচীনকাল থেকে বর্ষবরণের দিকে নজর দিতে হবে। বঙ্গ, আসাম তথা প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মণিপুর ইত্যাদি অঞ্চলে বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিক প্রচলন ছিল।

 

কৃষি কাজ, ফসল তোলা, বাণিজ্যিক লেনদেন, হালখাতা ইত্যাদিকেন্দ্রিক ছিল সে অনুষ্ঠানগুলো। ভারতে মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠার পর শাসকরা খাজনা ইত্যাদি হিজরি তারিখ অনুযায়ীই তুলতেন।

 

কিন্তু চন্দ্রনির্ভর হিজরি সনের সঙ্গে এখানকার মৌসুমি ফসল ওঠার পার্থক্য থাকায় শাসকদের খাজনা তোলা ও বার্ষিক হিসাব-নিকাশে সমস্যা তৈরি হয়।

 

ফলে মুঘল সম্রাট আকবর খাজনা আদায়ের সুষ্ঠু নীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সে মোতাবেক তৎকালীন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজী হিজরি সনকে ভিত্তি ধরে সৌর সনের সঙ্গে মিলিয়ে বাংলা সন চালু করেন।

 

ভাবে ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ কিংবা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের দিন- ৫ নভেম্বর ১৫৫৬ থেকে কার্যকর করা হয় বাংলা সন গণনা পদ্ধতি। যেমনটি ওমর (রা.) হিজরি সন গণনা শুরু করেন, তবে সেটি কার্যকর করেন মহানবী (সা.)-এর হিজরতের দিন থেকে।

 

কেন পহেলা বৈশাখকে আমরা মুসলমানের উৎসব বলব। প্রথমত, এ সন গণনার আদেশদাতা মুসলমান, নিয়মনীতি যিনি ঠিক করেছেন তিনিও একজন মুসলমান, এমনকি নবী (সা.)-এর হিজরতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে হিজরি বছরকে মূল ধরে তৈরি করা হয়েছে বাংলা পঞ্জিকা বর্ষ।

 

এ যখন বাস্তবতা তখন পহেলা বৈশাখকে মুসলমানের উৎসব বললে কি খুব বাড়াবাড়ি হবে? কিন্তু বাস্তবতা বলে অন্য কথা। পহেলা বৈশাখ বর্ষবরণের উৎসবে বর্তমানে যা কিছু হচ্ছে তাকে তো মুসলিম সংস্কৃতির মানদণ্ডে কোনোভাবেই ফেলা যাবে না।

 

সত্যি কথা বলতে কী, ভারতবর্ষের আজাদি আন্দোলনে আলেম সমাজ ও মুসলমান বীরদের আত্মত্যাগের ইতিহাস যেমন হাইজ্যাক হয়ে গেছে, তেমনই মুসলমানদের বানানো বর্ষবরণের জায়গা দখল করে নিয়েছে আজগুবি কতগুলো চর্চা-প্রথা। এ দায়ভার কার?

 

দেশের বেশিরভাগ মানুষ এখনও সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়ার জন্য নির্ধিদ্বায় হাজির হয় মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন ও আলেম সমাজের কাছে।

 

বিপদে-আপদে তাদের পরামর্শকেই প্রাধান্য দেয়। অথচ সে মানুষই কিনা কী ব্রিটিশ, কী পাকিস্তান- উভয়ের কাছ থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে এ আলেমদের অবদানের কথা জানে না। বর্ষবরণ ও বিভিন্ন উৎসব আয়োজনের ক্ষেত্রে আলেম সমাজ যতই বলুক জাত গেছে, শিরকি-বিধর্মী সংস্কৃতিতে যুবসমাজ ডুবে গেছে, তখন তারা কর্ণপাত করছে না।

 

এর পেছনে যে আলেম সমাজই দায়ী। প্রথমত, আলেম সমাজ মানুষের যুগোপযোগী চাহিদার বিষয়ে কর্ণপাত না করে, বছরের পর বছর মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে ইহকালীন জীবনেও যে তাদের কিছু বলার আছে, অপরিহার্য কিছু সত্য তুলে ধরার আছে, সে অবস্থান হারিয়ে ফেলেছেন।

 

যেমন যে কোনো ধরনের খেলাধুলা থেকে তারা নিরুৎসাহিত করছেন মানুষকে। আগপাছ না ভেবে ‘হারাম’ বলে দিতে পিছপা হচ্ছেন না। এ ক্ষেত্রে ভিন্ন দেশের জগদ্বিখ্যাত আলেমদের উপদেশকেও থোড়াই কেয়ার করছেন।

 

যেমন- বাংলা ভাষাকে আঁকড়ে ধরার পরামর্শ সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদবী (রহ.) বহু আগে দিলেও এখনও বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সেটি কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।

 

বর্ষবরণ কি ইসলামে নাজায়েজ? রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, হালাল স্পষ্ট এবং হারামও স্পষ্ট (বোখারি ও মুসলিম)। হাদিসে আরও এসেছে প্রতিটি জাতির নিজস্ব উৎসব আছে। কোনো জাতি ইসলাম গ্রহণ করলে তার সব সংস্কৃতি ছেড়ে দিতে হবে, এমন কোনো নির্দেশনা নেই।

 

আমরা দেখি, আরব সংস্কৃতিতে কেবল ক্ষতিকর, আল্লাহ এবং বান্দার হক বিঘœকারী উৎসবগুলোকেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অশ্লীল ও সীমালঙ্ঘনকারী বেপরোয়া আনন্দ-উৎসবের কারণে একজন সাহাবির (রা.) প্রাণহানির ঘটনায় মদ-জুয়ার মতো বিষয়কে নিষিদ্ধ করা হয়েছে সূরা মায়েদার ৯০ ও ৯১ নং আয়াতে।

 

কিন্তু যেসব জিনিস ক্ষতিকর নয়, ইসলাম তা নিষিদ্ধ করে না। একবার আম্মাজান আয়েশা (রা.)-এর সঙ্গে হাবশিদের রণকৌশলের খেলা দেখে রাসূল (সা.) প্রশংসা করে বলেছেন, কত সুন্দর এ আনন্দ। এ থেকে বোঝা যায় যদি ইসলামবিরোধী না হয়, বান্দা ও আল্লাহর হকের ক্ষতির কারণ না হয়, তবে যে কোনো ধরনের আনন্দ উৎসব জায়েজ।

 

পহেলা বৈশাখে যে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয় তাতে এক ধরনের পূজার কথা বলে তা কোনোভাবেই করা যাবে না বলেন আলেম সমাজ। পূজা বা আরাধনার জন্য সহি নিয়ত করতে হয়। এ ক্ষেত্রে তা হচ্ছে কিনা দেখা দরকার।

 

এর বাইরে অশ্লীল নাচগান ধর্মে অবশ্যই নিষিদ্ধ। এখনও গ্রামাঞ্চলে যেভাবে বৈশাখে ভালো খাবারের আয়োজন, হালখাতা, নতুন ফসলের রান্না ও অন্যান্য বিনোদন রয়েছে, সেটাই হাজার বছরের বর্ষবরণের সংস্কৃতি।

 

যদি ঢালাওভাবে নাজায়েজের ফতোয়া না দিয়ে আলেম সমাজই নববর্ষ পালনে এগিয়ে আসতেন, একটি বছর জীবন থেকে চলে যওয়ার ক্ষেত্রে করণীয় কী, কী করা যাবে, কী করা যাবে না তার বাস্তব নমুনা তুলে ধরতেন, হিজরি সনের সঙ্গে বাংলা সনের সম্পর্ক, বাংলা সন গ্রহণের প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করতেন, তবে পরিস্থিতি এরকম হতো না।

 

যে দেশের মানুষ নিজেদের একটি দোকান চালু করার সময়ও কোরআন তেলাওয়াত করাতে পছন্দ করে, তারা কোরআন তেলাওয়াত দিয়ে বর্ষবরণ শুরু ও মোনাজাত দিয়ে শেষ করত তাহলে। অপসংস্কৃতি দূর করতে হলে এর পাশাপাশি সুস্থ সংস্কৃতি চালু করতে হবে তবেই অপচর্চা দূর হবে। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দিন।