ই-পেপার | শুক্রবার , ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

দেশের ১৭ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীন

নিজস্ব প্রতিবেদক :

দেশে নানান পদক্ষেপের পরও উচ্চ মূল্যস্ফীতি কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। মানুষের আয় যতটা না বাড়ছে তার চেয়ে অনেক বেশি হারে বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়। দীর্ঘদিন ধরে খাদ্যের উচ্চমূল্যের কারণে খাবারের তালিকা কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছে সাধারণ মানুষ। যার ফল হিসেবে দেশের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে।

 

বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেশের ৪৩ শতাংশ পরিবারকে ঋণ করে খাবার কিনতে হয়েছে। আর মোট জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ ছিল খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায়। এর আগে গত বছর ডিসেম্বরে ঋণ করে খাবার কিনতে হয় ৪০ শতাংশ পরিবারকে। এ মাসে মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ ছিল খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায়। তার আগের মাস নভেম্বরে ঋণ করে খাবার কিনতে হয় ৪২ শতাংশ পরিবারকে আর মোট জনসংখ্যার ১৮ শতাংশ ছিল খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায়।

 

জাতিসংঘের এ প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা দীর্ঘমেয়াদে হচ্ছে। এ প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের পুষ্টিবিদরা বলছেন, এমন পরিস্থিতি দীর্ঘমেয়াদে চললে ভবিষ্যতে নেতিবাচক ফল পেতে হবে। বিশেষ করে, শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগছে, ফলে অতিমাত্রায় খর্বকায় শিশু দেখা যাবে। দেশে কর্মহীনতা বাড়বে। দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে জনমিতিক লভ্যাংশেও। দীর্ঘমেয়াদে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার কারণে মানুষের কার্যক্ষমতা কমে যাচ্ছে। আর কর্মক্ষম মানুষ কমে গেলে দেশের অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

 

ডব্লিউএফপি বাংলাদেশের জানুয়ারি মাসের খাদ্য নিরাপত্তা জরিপ প্রকাশ করেছে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি। তাতে জাতিসংঘের এ সংস্থাটি বলেছে, মৌসুমকেন্দ্রিক আয়ের সুযোগ বিপর্যস্ত হচ্ছে, বহুমুখী বিপদ খাবারের টেবিলে খাবারের পরিমাণকে বাধাগ্রস্ত করেছে। বাংলাদেশের সব বিভাগে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা সমান নয়, কোনো কোনো বিভাগে বিপদসীমা অতিক্রম করেছে বলেও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর গত দুই বছর ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি রয়েছে। টানা ২৪ মাস মজুরির চেয়ে দেশের মূল্যস্ফীতি বেশি। মজুরির চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেশি হলে অর্থনীতির শঙ্কা আরও বাড়ে।

 

পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের (পিইবি) জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ হাসনাত আলম বলেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষ কর্মচ্যুতও হচ্ছে। সব মিলিয়ে সঞ্চয় কমে গেছে, জীবনযাপনের ব্যয় বেড়ে গেছে। ফলে যেসব পণ্য না কিনলেই নয়, বিশেষ করে চাল-ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনার জন্য মানুষ ঋণ করে কিংবা সঞ্চয় ভেঙে খেতে হচ্ছে।’এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ‘প্রয়োজনীয় ছাড়াও মানুষ অন্যান্য পণ্যও কেনা কমিয়ে দিয়েছে। বিক্রি কমে যাওয়ায় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোও বাধ্য হয়ে তাদের কর্মী ছাঁটাই করবে। তবে আমাদের মুদ্রানীতির কারণে এটা কিছুটা কমছে।’

 

ডব্লিউএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জানুয়ারিতে তীব্র শীতের কারণে নিম্নআয়ের মানুষ বিশেষ করে দৈনিক মজুরিতে কাজ করা শ্রমিক, রিকশা ও ভ্যানচালকরা বেশিরভাগ দিন কাজে যেতে পারেননি। এ ছাড়া নারীপ্রধান পরিবারগুলোতে খাবার জোগানোর ক্ষেত্রে অক্ষমতা বেড়েছে। এ সময়ে পুরুষের তুলনায় নারী শ্রমিকরা তুলনামূলক কম বেতন পেয়েছেন। কিছু পরিবার তাদের আত্মীয়স্বজন কিংবা কাছের মানুষের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা নিয়ে চলতে হয়েছে বলে উঠে এসেছে জরিপে।

 

জাতিসংঘের জরিপ বলছে, ৩০ শতাংশ নিম্ন আয়ের পরিবার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন, যেখানে ৮ শতাংশ মধ্যম আয়ের পরিবার এ ধরনের সমস্যায় রয়েছে। উচ্চ আয়ের ৩ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে বলে উঠে এসেছে জরিপে।২০২২ সালের জুলাইয়ের পর থেকে ১৯টি জরিপে সংস্থাটি দেখতে পেয়েছে, বাংলাদেশে খাদ্যের উচ্চমূল্য, জীবনযাপনে উচ্চব্যয়, মৌসুমি অভিঘাতসহ বিভিন্ন কারণে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে।

 

বাংলাদেশের উচ্চ খাদ্যমূল্যের কারণে সব ধরনের আয়ের জনগোষ্ঠীই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ৯০ শতাংশ পরিবার বলছে, ফসল কাটার মৌসুমেও উচ্চ খাদ্যমূল্য তাদের জীবন বাধাগ্রস্ত করেছে, তাদের আয়ের ওপর বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করেছে। যারা দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করেন, তাদের আয় এ সময়ে অর্ধেকে নেমে এসেছে।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. সাইদুল আরেফিন মনে করেন, দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে কম খাবার খেতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘যেসব খাবার আমাদের শরীরের জন্য খুব বেশি প্রয়োজন সেগুলো আমরা পর্যাপ্ত পরিমাণ খেতে পারছি না। বিশেষ করে যেসব খাবার আমাদের শরীরে প্রোটিন তৈরি করে, যেগুলো ছাড়া প্রোটিন তৈরি হবে না সেই আমিষ আমরা পর্যাপ্ত পরিমাণে নিতে পারছি না। যদিও আমরা শর্করা জাতীয় খাবার পাচ্ছি। অন্য খাবার পাচ্ছি না।’

 

দীর্ঘমেয়াদে এ ধরনের প্রভাব থাকলে তার নেতিবাচক দিক উল্লেখ করে এ পুষ্টিবিদ বলেন, ‘প্রান্তিক মানুষের জন্য এ ধরনের প্রভাব বাড়ছে, যা সামনে আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। এটি হলে কার্যক্ষমতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেতে পারে।’

 

প্রতি দশ পরিবারের মধ্যে সাতটি পরিবার জীবন-জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে কৌশলী অবস্থান নিয়েছে। কৌশলগুলোর মধ্যে রয়েছে টাকা ধার করে চলা, উৎপাদনশীল সম্পদ বিক্রি করে দেওয়া, খাদ্য কেনার জন্য ঋণ নেওয়া। এভাবে চাপে থাকা ও কৌশলী হওয়া পরিবারের সংখ্যা বেড়েছে। শুধু খাদ্যের জন্যই নয়, পরিবারগুলো জীবনযাপনের ক্ষেত্রেও এমন কৌশল নিয়েছে।

 

ড. সাইদুল আরেফিন বলেন, ‘দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে মধ্যবিত্তের জন্য এটি আরও কঠিন হয়ে পড়ছে। যারা মোটামুটি পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খেত, তারা সেটিও পাচ্ছে না। এর ফলে আমাদের কর্মক্ষেত্রে কার্যক্ষমতা খুব বেশি ব্যাহত হচ্ছে।’

 

দেশের বিভাগগুলোর মধ্যে ১২ থেকে ২৬ শতাংশ পর্যন্ত গড় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে। বিভাগগুলোর মধ্যে চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা রয়েছে, এ বিভাগে ২৬ শতাংশ পরিবার এমন পরিস্থিতিতে রয়েছে। বাকি বিভাগগুলোর মধ্যে সিলেটে ১৮ শতাংশ, খুলনা, বরিশাল ও ঢাকায় ১৭ শতাংশ, ময়মনসিংহ ও রাজশাহীতে ১৩ শতাংশ এবং রংপুরে ১২ শতাংশ পরিবার খাদ্য নিরাপত্তাহীন।

 

জানুয়ারিতে ১০ থেকে ১৫ দিনেরও বেশি সময় ধরে অপ্রত্যাশিত শৈত্যপ্রবাহ অনেক পরিবারকে, বিশেষ করে যারা দৈনিক শ্রমের ওপর নির্ভর করে এমন নিম্নআয়ের গোষ্ঠীকে বিপাকে ফেলেছে। প্রচণ্ড ঠা-ার কারণে ফসলের ক্ষতির খবরও পাওয়া গেছে।

 

জরিপে উঠে এসেছে, গত ছয় মাসে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে, পাশাপাশি পরিবারগুলোর পর্যাপ্ত খাবার পাওয়া নিয়ে আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। দেশের আট বিভাগের ৩১ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে, তাদের অপর্যাপ্ত খাবার কিনতে হচ্ছে। এটি দীর্ঘদিনের জন্য উদ্বেগজনক চিত্র বলেও উঠে এসেছে জরিপে। ৪০ শতাংশ নিম্ন আয়ের পরিবারে খাবারের তালিকায় নিম্নমানের খাবার ছিল।

 

ডব্লিউএফপি বলছে, বাংলাদেশে গত ছয় মাসে উচ্চ-পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো উন্নতি হয়নি। মাত্র ১৩ শতাংশ পরিবারের খাবারের প্লেটে এ সময় আয়রনসমৃদ্ধ খাবার ছিল, ৮১ শতাংশ পরিবারে মাঝেমধ্যে ছিল আর এ জরিপ শেষ হওয়ার আগের সাত দিনে ৬ শতাংশ পরিবারের এ ধরনের কোনো খাবারই ছিল না। নিম্নআয়ের পরিবারগুলোর খাবারের প্লেটে পুষ্টিকর খাবার রাখার সামর্থ্য ছিল না।

 

পুষ্টিবিদ ড. সাইদুল আরেফিন বলেন, ‘খাদ্য নিরাপত্তা না থাকলে পুষ্টিহীনতা দেখা দেবে। এটি ধারাবাহিকভাবে চললে প্রভাব পড়বে বাচ্চাদের ওপর। বড়রা কিছুটা এটি মানিয়ে নিলেও বাচ্চারা এটি নিতে পারে না। ফলে দেখা যাবে, তারা খর্বকায় হবে বা ওজন স্বল্পতায় ভুগবে। খুব স্বাভাবিকভাবে তাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। ফলাফলস্বরূপ ভবিষ্যতে আমাদের দেশে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। আমাদের জনমিতিক লভ্যাংশেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’

 

জরিপের তথ্য বলছে, দেশের ৩১ শতাংশ মানুষ শুধু খাবারের ক্ষেত্রে কৌশলী অবস্থান নিয়েছেন, জীবনযাপনের ব্যয়ে কৌশলী ৬৮ শতাংশ মানুষ। ২৫ শতাংশ মানুষ বলছে, স্বাস্থ্য ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় তারা বিপাকে পড়েছে। আবার পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি এবং পারিবারিক ব্যয় বহন করতে গিয়ে ঋণ বেড়ে গেছে বলে অনেকে জানিয়েছে। মধ্যম আয়ের পরিবারগুলো সঞ্চয় থেকে বিরত থাকার কথা জানিয়েছে। উচ্চ আয়ের পরিবারগুলো দামের অস্থিরতার কারণে তাদের কেনাকাটার তালিকার আকার পরিবর্তন করেছে বলে উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।

সূত্র:দেশ রূপান্তর।