আবদুল আজিজ, বাংলা ট্রিবিউন:
মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) জন্য বিদেশ থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অর্থ আসার তথ্য ফাঁস করেছে র্যাবের হাতে গ্রেফতার সংগঠনটির শীর্ষ নেতা মাওলানা মোহাম্মদ ইউনুস। র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানিয়েছেন, আরসার জন্য সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, দুবাই ও আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে টাকা আসে। সেই টাকায় সংগঠনের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় মিয়ানমারে, অপরাধ কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে।
শুক্রবার (২৫ আগস্ট) বিকালে র্যাব-১৫ এর কক্সবাজার কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে কোম্পানি কমান্ডার মেজর জামিলুল হক এ তথ্য জানান।
মেজর জামিল জানান, সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ কক্সবাজার জেলাজুড়ে হত্যা, লাশ গুম, অপহরণ, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। যেখানে ক্যাম্প ঘিরে গড়ে উঠেছে নানা সন্ত্রাসী সংগঠন। এর মধ্যে অন্যতম একটি দল আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)। তাদের নানা অপরাধ ক্যাম্পে বিস্তার করেছে ব্যাপকভাবে। ফলে অস্থিতিশীল পরিবেশ পুরো ক্যাম্প। বিভিন্ন সময় একাধিক অভিযানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে অনেকে আটক হলেও নির্মূল হয়নি সংগঠনটি। এবার অভিযান চালিয়ে আরসার শীর্ষ সন্ত্রাসী ও অর্থ সম্পাদক মাওলানা মোহাম্মদ ইউনুসকে গ্রেফতার করেছে র্যাব সদস্যরা।
তিনি জানান, গত ২৪ আগস্ট একটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের তাজনিমার খোলা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে তাকে গ্রেফতার করা হয়। অভিযান পরিচালনাকালে তার হেফাজতে থাকা একটি বিদেশি রিভলবার, ছয় রাউন্ড তাজা কার্তুজ ও একটি স্মার্ট ফোন উদ্ধার করা হয়। ইউনুস (৪০) ক্যাম্প ১৯ সি ব্লক/১৪ এর মৃত হাবিবুল্লাহর ছেলে।
র্যাব জানায়, ইউনুস মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন। মিয়ানমারে থাকাবস্থায় মংডু টাউনশিপের মেরুল্লা মাদ্রাসায় শিক্ষকতা ও আরসার হয়ে কাজ করতেন। ২০১৬ সালে ‘আরসা’ সদস্য মৌলভী আরিফুল্লাহর মাধ্যমে সংগঠনে যোগ দেন। সংগঠনের আমির আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনী, ওস্তাদ খালেদ, সমউদ্দিনের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের মাধ্যমে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আলেম-ওলামা, হেড মাঝি, সাব-মাঝি ও সাধারণ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিটিং করে আরসা সংগঠনে যোগদানের জন্য উৎসাহ দেন। এ ছাড়াও তিনি রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় আরসার অর্থ সম্পাদকের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন এবং আর্থিক তহবিল পরিচালনা করছেন।
পরে সে ২০১৭ সালে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন এবং শরণার্থী হিসেবে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প-১৯ এ অবস্থান করতে থাকেন। আরসার অর্থের উৎস সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদে মাওলানা ইউনুস জানান তার কাছে প্রতি মাসে সৌদি আরব থেকে আবুল বশর এক লাখ, মৌলভী ইসমাইল এক লাখ, মো. ইসলাম এক লাখ, পারভেজ ১৫ হাজার, আমেরিকা থেকে জহুর আলম এক লাখ, মালয়েশিয়া থেকে হারুন এক লাখ ও থাইল্যান্ড থেকে হারুন ৬৫ হাজার টাকাসহ সর্বমোট পাঁচ লাখ ৮০ হাজার টাকা তাদের কাছে পাঠান। এ ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া থেকে অজ্ঞাত রোহিঙ্গা টাকা পাঠান।
গ্রেফতার ইউনুস
মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গাদের গ্রাম থেকে চাঁদা সংগ্রহ করা হয়। প্রতি মাসে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ১০-১৫ লাখ টাকা আরসার ক্যাম্প জিম্মাদারদের কাছে আসে। এই অর্থ দিয়ে অস্ত্র কেনা ও দলের সদস্যদের আর্থিক সহযোগিতা/বেতন দিয়ে থাকেন। বর্তমানে ইউনুসের মোবাইল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আনুমানিক ৩৩ থেকে ৩৭ হাজার টাকা রয়েছে।
র্যাব-১৫ এর কমান্ডার জানান, জিজ্ঞাসাবাদে র্যাবকে জানিয়েছেন, ইউনুস আরসার সংগঠনের জন্য চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন- এই তিন মাসে আরসা সমর্থিত বিভিন্ন গ্রুপ, ব্যক্তি ও সংগঠন থেকে প্রায় ১৩ লাখ ৮১ হাজার ৬৯৫ টাকা নিয়েছেন। আরসার গ্রুপে ২০০-২৫০ জন সদস্য রয়েছে। তারা ২০১৬ সালে মিয়ানমারে তারাশুখ থানায় আক্রমণ করে মোট ৭০টি একে-৪৭ অস্ত্র লুট করে এবং এটি তাদের অস্ত্র সরবরাহের মূল উৎস বলে জানা গেছে। সংগঠনের অন্যতম সদস্য সমিউদ্দিন (ক্যাম্প-৬) এবং হোসেন (ক্যাম্প-১৭) অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিষয়ে বিস্তারিত জানে।
তিনি জানান, এ ছাড়া তিনি জানান ছোট ছোট অস্ত্র ও গোলাবারুদ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সরবরাহ করে থাকে। আরসা সদস্যরা সেগুলো ক্যাম্পে নিয়ে আসার পর সমিউদ্দিন ও ইউনুসের কাছে জমা থাকে। পরে তাদের অধীনে সব সদস্যদের অস্ত্র বণ্টন করে থাকে। সমিউদ্দিন ও জোবায়ের ককটেল বোমা বা বিস্ফোরক তৈরি করেন। ক্যাম্পে দেশীয় তৈরি এলজি অস্ত্রের চাহিদা বেশি। আরসা সদস্যরা অস্ত্র কেনার পর নগদ অর্থ হাতে হাতে অথবা বিকাশের মাধ্যমে টাকা লেনদেন করেন।
র্যাবের এই কমান্ডার বলেন, মিয়ানমারের বুথিডং ও মংডু শহরের মাঝে বিভিন্ন ছোট ছোট পাহাড়ে ওস্তাদ খালেদ, সামসু ও হামিদ হোসেন আরসা সদস্যদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেন। ইউনুসের কাছ থেকে আরসা সদস্যদের বিভিন্ন সাংকেতিক শব্দ পাওয়া যায়- KRG/KIG- পাহারাদার গ্রুপ- ১৩-১৫ বছর বয়সের আরসা সদস্য। G-4 – মাস্টার রফিক। L/L Gan- জোবায়ের (আঙ্গুল বাঁকা) এবং 5.S/5.Star- মাস্টার ইউনুস। বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসার সদস্যদের কাছে প্রায় ২০টি টাইপ-৭৪ এলজি, জেআরজি অস্ত্রসহ ও বিপুল পরিমাণে হাত বোমা রয়েছে। আরসা কমান্ডার সমিউদ্দিনের সাথী রোহিঙ্গা ফরিদ, মোহাম্মদ উল্লাহ ও ইউসুফসহ অনেকের কাছে অস্ত্র রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলার এই কর্মকর্তা আরও বলেন, গ্রেফতার ইউনুসের বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় সর্বমোট পাঁচটি মামলা পাওয়া গেছে। সেগুলো হলো- ২০২২ সালের ১৫ অক্টোবর হেড মাঝি আনোয়ারকে কুপিয়ে হত্যা, চলতি বছরের ৩ মার্চ রোহিঙ্গা মোহাম্মদ রফিককে গুলি করে হত্যা, ১৩ মার্চ ক্যাম্পে আগুন লাগানোর নির্দেশদাতা, ১১ এপ্রিল ও ৯ জুন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এপিবিএন অভিযান চালানোর সময় সশস্ত্র হামলা। এ ছাড়াও তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আরও কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে র্যাবের কাছে স্বীকার করছে।