সালেহ আহমদ (স’লিপক), সিলেট
মৌলভীবাজারে বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ট সহচর, সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমানের ৩য় মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হয়েছে।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার ৭নং চাঁদনীঘাট ইউনিয়ন পরিষদের গুজারাই গ্রামে তাঁর নিজ বাসভবন প্রাঙ্গনে স্মরণসভা, শিক্ষাবৃত্তি ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেছে বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান ফাউন্ডেশন।
শুক্রবার (১৮ আগষ্ট) বাদ জুম্মা গুজারাই হাজী শাহ্ কামাল উদ্দিন (রহ.) মোকাম মসজিদ ও চাঁদনীঘাট জামে মসজিদ এ মিলাদ দোয়া মাহফিল এবং দুপুর ২টায় কবর জিয়ারতে মধ্যে দিয়ে শুরু অনুষ্ঠানমালা।
দুপুর ২টায় বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান এর কবর জিয়ারত করেন মৌলভীবাজার-রাজনগর ৩ আসনের সংসদ সদস্য নেছার আহমদ, পৌর মেয়র আলহাজ্ব মোঃ ফজলুর রহমান, সাবেক জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ জামাল উদ্দিনসহ সংগঠনের নেতা-কর্মী।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান ফাউন্ডেশনের উদ্যেগে পৌর মিলনায়তনে বিকেল ৪টায় স্বরণসভা ও শিক্ষাবৃত্তি অনুষ্ঠান ফাউন্ডেশন এর আহবায়ক সাবেক জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ জামাল উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়।
ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব ও মৌলভীবাজার প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক পান্না দত্তের সঞ্চালনায় প্রধান অতিথি ছিলেন মৌলভীবাজার-রাজনগর -৩ আসনের সংসদ সদস্য নেছার আহমদ।
বিশেষ অতিথি ছিলেন হবিগঞ্জ-মৌলভীবাজার সংরক্ষিত মহিলা সংসদ সদস্য সৈয়দা জোহরা আলাউদ্দিন, জেলা প্রশাসক ড. উর্মি বিনতে সালাম, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মিছবাহুর রহমান, পুলিশ সুপার মোঃ মনজুরর রহমান (পিপিএম বার), পৌর মেয়র আলহাজ্ব মোঃ ফজলুর রহমান, সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মোঃ কামাল হোসেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা দেওয়ান আবদুল ওয়াহাব চৌধুরী।
স্বাগত বক্তব্য রাখেন ফাউন্ডেশনের সদস্য মোহাম্মদ আবদুল খালিক। স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক এমপি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, জাতীয় নেতা মরহুম আলহাজ্ব আজিজুর রহমান এর ২য় মৃত্যু বার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি, বৃত্তি প্রদান, স্মরণসভা, স্মৃতিচারণ, প্রার্থনা, ভাবগম্ভীর পরিবেশে বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে পালিত অনুষ্ঠানমালায় জেলার সকল শ্রেণী পেশার নেতৃস্থানীয় বিজ্ঞজনরা উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা, বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ, মরহুম আজিজুর রহমান ব্যক্তিজীবনে সদা হাস্যোজ্জ্বল সরল ও মিষ্টভাষী মানুষ ছিলেন। মৌলভীবাজার জেলার গুজারাই গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৪৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মরহুম আব্দুল সত্তার, মাতা মরহুম কাঞ্চন বিবি। তিনি শ্রীনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু করেন।
মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় হতে মাধ্যমিক ও মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। উচ্চ শিক্ষার জন্য ঢাকা কলেজে ভর্তি হলেও শারীরিক অসুস্থতার কারণে হবিগঞ্জের বৃন্দাবন কলেজ হতে বিকম ডিগ্রী অর্জন করেন।
ছাত্রজীবন হতেই সক্রিয় রাজনীতির সাথে জড়িত আজিজুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর সরাসরি নির্দেশনায় ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে প্রাদেশীক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ কারাবরণ করেন তিনি। এরপর একই বছরের ৭ এপ্রিল মুক্তিবাহিনী কর্তৃক জেল ভেঙ্গে সিলেট কারাগার থেকে তাঁকে মুক্ত করা হয়। ২ মে পুন:রায় পাকবাহিনী মৌলভীবাজার শহরে প্রবেশ করে বর্বরোচিত দমনপীড়ন চালানোর পর ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে আত্মনিয়োগ করেন তিনি। একপর্যায়ে মুজিবনগর সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি কর্তৃক আহুত পশ্চিমবঙ্গের বাগডুগায় (দার্জিলিং) প্রথম পার্লামেন্ট অধিবেশনে যোগদান করেন আজিজুর রহমান। প্রবাসী সরকার কর্তৃক আয়োজিত সামরিক প্রশিক্ষণে সিলেট বিভাগের একমাত্র প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য হিসেবে তিনি সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এবং ৪ নম্বর সেক্টরের রাজনৈতিক কো-অর্ডিনেটর ও কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সক্রিয় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এবং গণপরিষদ সদস্য হিসেবে ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর শমসেরনগর, ৬ ডিসেম্বর রাজনগর এবং ৮ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে মৌলভীবাজারকে হানাদার মুক্ত ঘোষণা করেন আজিজুর রহমান।
গণপরিষদের এই সদস্য স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য রচিত সংবিধানের একজন স্বাক্ষরকারী। তিনি ১৯৮৬ ও ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় হুইপ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় সংবিধানের একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনীতে তিনি বিশেষ অবদান রাখেন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ মৌলভীবাজার জেলা শাখার দুই বার সাধারণ সম্পাদক ও দুই বার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও পরবর্তীতে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি মৌলভীবাজার জেলায় ১৪ দল ও মহাজোটের সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
অকৃতদার এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মৌলভীবাজার মহিলা কলেজ (বর্তমানে সরকারী) ও সৈয়দ শাহ্ মোস্তফা কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি হিসেবে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখেন। তিনি মৌলভীবাজার জেলার অন্যতম সাংস্কৃতিক সংগঠক ছিলেন। সামাজ কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি মৌলভীবাজার শাখার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
২০১১ সালের ২০ ডিসেম্বর স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রজ্ঞাপনমূলে মৌলভীবাজারে প্রশাসক হিসেবে যোগদান করেন আজিজুর রহমান। পরবর্তীতে ২০১৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত জেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। মৃত্যুকালীন সময় পর্যন্ত জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় বেসামরিক স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান।