ই-পেপার | বুধবার , ২৬শে জুন, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

দুদকের যত আলোচিত মামলা

জামাল উদ্দিন

বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার নিয়ে বিগত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি ঘটনা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে— পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস। এই প্রতিষ্ঠানটি অন্য আরও ৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখলে নিয়ে ১০ বছরে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও দেশের বাইরে পাচার করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও পিপলস লিজিংয়ের প্রধান ব্যক্তি পি কে হালদার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে দুদকের দায়ের করা ৩৭টি মামলায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে।

 

এছাড়া বিকল্প ধারার মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান, বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু, সরকার সমর্থিত ১৪ দলীয় জোটের অংশীদার তরিকত ফেডারেশনের সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী, বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস ও আফরোজা আব্বাসসহ অনেক রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী রয়েছেন দুদকের দায়ের করা মামলায় আসামির তালিকায়। নোবেল বিজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূসের নামও বাদ যায়নি দুদকের মামলা থেকে। গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান হিসেবে শ্রমিক-কর্মচারীদের ২৫ কোটি টাকার বেশি আত্মসাতের অভিযোগে তাকে মামলায় আসামি করা হয়েছে।

 

দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্ত:
বিগত পাঁচ বছরে কতগুলো অভিযোগের অনুসন্ধান ও কত মামলার তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সেই তথ্য জানা যায়নি। তথ্য অধিকার আইনে দীর্ঘ দুই মাস আগে দুদকের কাছে এ সংক্রান্ত তথ্য চেয়ে আবেদন করা হলেও এখনও পর্যন্ত তাদের কাছ থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন মাধ্যম ও সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য নিয়েই ‘দুদকের ভেতর-বাহির’ শীর্ষক ধারাবাহিক প্রতিবেদনগুলো তৈরি করা হয়েছে। তবে দুদকের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, আগের বছরগুলোর অনিষ্পন্ন অনুসন্ধানের সংখ্যা তিন হাজার ৭০৬টি। ২০২২ সালে নতুন করে আরও ৯২৭টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করা হয়। ওই বছর এক হাজার ১১৯টি অনুসন্ধান কার্যক্রম শেষ করে দুদক। তবে অনুসন্ধানের পর মামলা দায়ের করা হয় মাত্র ৪০৬টি। বাকিগুলো পরিসমাপ্তি ও অন্যান্যভাবে নিষ্পত্তি করা হয়।

 

অনিষ্পন্ন তদন্তসহ ২০২২ সালে দুদকের মোট তদন্তের সংখ্যা ছিল এক হাজার ৯৯৭টি। এরমধ্যে ৩৩১টি তদন্ত শেষ করা হয়।তারমধ্যে আবার ৯৩ মামলার তদন্ত শেষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। ২২৪টি মামলায় চার্জশিট বা অভিযোগপত্র দেওয়ার অনুমোদন দেওয়া হয়।

 

আদালতে বিচারাধীন মামলা:
দুদকের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নিম্ন আদালতে তিন হাজার ২৭৫টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এরমধ্যে দুই হাজার ৮৪৭টি মামলার বিচার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে ৪৩১টি মামলার কার্যক্রম। উচ্চ আদালতে ৬৭৬টি রিট ও ফৌজদারি অপরাধের বিবিধ মামলা রয়েছে ৮২৯টি। এক হাজার ১৩৬টি ক্রিমিনাল আপিল মামলা ও ৫৭৮টি ফৌজদারি রিভিশন মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এই প্রতিবেদনে কয়েকটি আলোচিত মামলা ও ঘটনার উল্লেখ করা হলো।

 

বেসিক ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারি:
বেসিক ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় দায়ের হওয়া ৫৯টি মামলায় আদালতে চার্জশিট বা অভিযোগপত্র দিয়েছে দুদক। ২০১৫ সালে এসব মামলা হলেও কোনও মামলার এজাহারেই আসামি হিসেবে নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি ব্যাংকটির চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর। যদিও এসব কেলেঙ্কারির মূল কারিগর হিসেবে সবার আঙ্গুল ছিল তার দিকে। এ নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনাও কম হয়নি। তবে দীর্ঘ আট বছর পর গত ১২ জুন তদন্ত শেষে এই ৫৯টি মামলার ৫৮টির চার্জশিটেই আসামি হিসেবে তার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

 

ড. মুহাম্মদ ইউনুস:
গ্রামীণ টেলিকম থেকে শ্রমিক-কর্মচারীদের ২৫ কোটি ২২ লাখ ৬ হাজার ৭৮০ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ৩০ মে মামলাটি দায়ের করেন দুদকের উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার।

 

গ্রামীণ টেলিকমের ওয়ার্কার্স প্রোফিট পার্টিসিপেশন ফান্ডের (ডাব্লিউপিপিএফ) অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে দুদক অনুসন্ধান শেষে গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনুসসহ ১৩ জন বোর্ড সদস্যের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯, ৪২০, ৪৬৭, ৪৬৮, ৪৭১ ও ১০৯ ধারা এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২-এর ৪(২)(৩) ধারায় দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১-এ মামলাটি দায়ের করা হয়।

 

পি কে হালদার বাংলাদেশের আর্থিক খাতে অর্থ লোপাট ও পাচারের অন্যতম খলনায়ক প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদার। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে ৩৭টি মামলা দায়ের করে। দুদকের উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানের নেতৃত্বাধীন একটি টিম এসব মামলা করেন। এরমধ্যে দুটি মামলার বিচার চলছে আদালতে। বাকি মামলাগুলোর তদন্ত চলছে এখনও। পি কে হালদারের প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে— ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে এই চারটি প্রতিষ্ঠান দখলে রেখে পি কে হালদার ও তার সহযোগীরা প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা লোপাট করেন এবং সেই অর্থ দেশের বাইরে পাচারের অভিযোগ রয়েছে। যদিও এ পর্যন্ত দুদকের ৩৭টি মামলায় পি কে হালদার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ আনা হয়।

 

গত বছরের ১৪ মে পি কে হালদার পশ্চিমবঙ্গে ধরা পড়েন ভারতের কেন্দ্রীয় আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) হাতে। এরপর থেকেই ভারতের কারাগারে আছেন বাংলাদেশের আর্থিক খাতের কেলেঙ্কারির এ খলনায়ক।

 

পিকে হালদারকে ফেরানো ও তার পাচার করা অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে দুদকের কমিশনার জহুরুল হক এর আগে বলেছেন, পি কে হালদারকে ফেরত আনার বিষয়টি তাদের একক এখতিয়ারে নেই। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় এ ব্যাপারে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিছুদিন পর পর তাগাদাও দেওয়া হচ্ছে। সূত্র:বাংলা ট্রিবিউন।

 

এইচ এম কাদের,সিএনএন বাংলা২৪