নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাজধানী ঢাকার যানজট নিরসনে গত দুই দশকে উড়ালসড়ক, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বিআরটি, ইউলুপ ও মেট্রোরেলসহ নানারকম উড়ালপথ নির্মিত হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় বিস্তৃত মোট ১০৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এসব উড়ালপথের নিচে দখল-বেদখল, ব্যবহার-অব্যবহার ও অপব্যবহারে পড়ে আছে প্রায় ২০৭ একর জমি। ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকায় এটি মূল্যবান নগর-সম্পদের অপচয়, যার বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাবের ফলে প্রতিবছর সামাজিক, অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ও জনস্বাস্থ্যগত ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ওপরে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা অন্তত ২১ হাজার কোটি টাকা।
সম্প্রতি জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) অর্থায়নে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইনক্লুসিভ আর্কিটেকচার অ্যান্ড আরবানিজমের (সিআইএইউ) এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। তবে সিআইএইউ বলছে, ঢাকার আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে জনকল্যাণমুখী ও জনস্বাস্থ্য-বান্ধব পরিকল্পনার মাধ্যমে উড়ালপথের নিচের এই মূল্যবান নগর-জমিকে সম্পদে পরিণত করা সম্ভব। উড়ালসড়কের গতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত না করেই তা ‘সবুজ’ অবকাঠামোয় পরিণত করে বহুমুখী কাজে ব্যবহার করা যাবে। এতে নগরের বাসযোগ্যতা বৃদ্ধির পাশাপাশি পথচারীবান্ধব নগরায়ন ত্বরান্বিত হবে।
রোববার (২৫ জুন) বিকেলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সিআইএইউয়ের সেমিনার রুমে এ সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। সিআইএইউ’র নির্বাহী পরিচালক স্থপতি অধ্যাপক ড. আদনান জিল্লুর মোর্শেদ মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসের নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার মনজুর হাসান, ইউএনডিপির সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি আনোয়ারুল হক, সাংবাদিক এম এম মুসা প্রমুখ। এছাড়াও পরিকল্পনাবিদ, অর্থনীতিবিদ, গবেষক এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কয়েকজন সাংবাদিক এতে অংশ নেন।
এ সময় অধ্যাপক ড. আদনান জিল্লুর মোর্শেদ জানান, ফ্লাইওভার যেমন নগরের আভ্যন্তরীণ যোগাযোগব্যবস্থাকে গতিশীল করছে, তেমনি এর নিচের জায়গাগুলোও গণপরিসর তৈরিতে ও জনকল্যাণমুখী কাজে ব্যবহার করার সুযোগ আছে।
একনজরে ঢাকার উড়ালপথ
ঢাকায় প্রথম উড়ালসড়ক চালু: ২০০৪ সাল
প্রথম উড়ালসড়ক: মহাখালী ফ্লাইওভার
মোট উড়ালসড়কের সংখ্যা: ১০টি
উড়ালপথের মোট দৈর্ঘ্য: ১০৫.২২ কিলোমিটার
উড়ালপথের জায়গাগুলো নিয়ে কোনো পরিকল্পনা না থাকায় প্রতিবছর ক্ষতি ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার
তিনি বলেন, মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার ও মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নিচে বেশকিছু জায়গায় পার্কিং, পাবলিক টয়লেট, পুলিশ বক্স, মসজিদ, অস্থায়ী কাঁচাবাজার, ময়লা ফেলার ভাগাড় এবং ছোট দোকান গড়ে উঠেছে। কোথাও কোথাও অন্ধকারে ছিন্নমূল মানুষের থাকার জায়গা চোখে পড়েছে। কিছু কিছু জায়গায় নিম্নবিত্ত ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা জীবিকা নির্বাহ করছেন ও পথশিশুরা খেলাধুলার জন্য ব্যবহার করছে। অনেকসময় অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গাগুলোতে মাদকসেবন ও মাদক কেনাবেচা হয়। পথচারীদের জন্যও এটি নিরাপত্তার হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে কিছু কিছু জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে সবুজায়ন করতে দেখা গেছে। মূল বিষয় হলো, সামগ্রিকভাবে এ নিয়ে কোনো নীতিমালা নেই। ফলে বেশিরভাগ জমির সুষম ব্যবহার নিশ্চিত হয়নি।
ড. আদনান জিল্লুর মোর্শেদ বলেন, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে বর্তমানে ফ্লাইওভার ও এলিভেটেড স্ট্রাকচারের নিচের অংশে জনবান্ধব, টেকসই ও সাশ্রয়ীভাবে ব্যবহার উপযোগী কমিউনিটি জোন তৈরি করা হচ্ছে, যেখানে থাকছে হাঁটাচলার পথ ও সাইকেলের লেন, নগর-কৃষি, বাগান, বনায়ন ও খেলাধুলার ব্যবস্থা। কিছু জায়গায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও শরীরচর্চা কেন্দ্র, সুইমিং পুল, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং পথনাটক ও শিল্পকর্ম প্রদর্শনের ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। অনেক জায়গায় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বা নিম্নআয়ের মানুষেরা সম্পৃক্ত হচ্ছেন। উড়ালসড়কের মতো অবকাঠামোর বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা। এ বিষয়ে নগর প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং পরিকল্পনাগত ঘাটতি পূরণে অবদান রাখাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য।
জানা গেছে, এই গবেষণা প্রকল্পের পদ্ধতি হিসেবে ঢাকার বিভিন্ন ফ্লাইওভার-সংলগ্ন এলাকার স্থানীয়দের মাঝে নৃতাত্ত্বিক জরিপ করা হয়েছে, যেখানে ব্যবসায়ী, অস্থায়ী দোকানদার, বাসাবাড়িতে বসবাসকারী মানুষ, পথচারী এবং সড়কের শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। জরিপের প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে তাদের প্রতিদিনকার জীবনে ফ্লাইওভার ও এর নিচে ঢাকাপড়া জায়গার প্রভাব নিয়ে সমীক্ষা চালানো হয়েছে। এর পাশাপাশি অর্থনীতিবিদ, পরিবহন বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী, নগর পরিকল্পনাবিদ, পরিবেশবিদ, স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তাগণ ও আইনবিদদের সহায়তায় সার্বিক নীতিমালায় পরিবর্তন আনার ব্যাপারে নতুন কিছু ধারণা পাওয়া গেছে।
উড়ালসড়কের নিচের অব্যবহৃত জমির কার্যকর রূপান্তরের এই গবেষণায় ড. আদনান জিল্লুর মোর্শেদের নেতৃত্বে কাজ করেছেন স্থপতি শাফায়েত মাহমুদ, ওয়াসিলা ফাতিমা নিলিয়া এবং মো. ফাহিম হাসান রিজভী। এছাড়া বিভিন্ন ধাপে পরামর্শক হিসেবে যুক্ত ছিলেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী খান, বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক, অর্থনীতিবিদ ড. সৈয়দ আখতার মাহমুদ, নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ, সওজ’র অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ড. ওয়ালিউর রহমান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. তানজিনুল হক মোল্লা এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক তানভীর সোবহান।
ড. আদনান জিল্লুর মোর্শেদ আরও বলেন, আমরা চাই বাংলাদেশের শহরগুলো যেন জনকল্যাণে নগর-জমির সর্বোত্তম ব্যবহার করতে পারে, যা আমাদের জন্য সামগ্রিকভাবে লাভজনক হবে। তবে ঢালাওভাবে কোনো রৈখিক পরিকল্পনা না করে স্থানীয় এলাকার আর্থসামাজিক চরিত্র ও বর্তমান ব্যবহারের ধরন বুঝে উড়ালপথের নিচের জায়গাগুলোর সুষম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। নিম্নবিত্তের মাথা গোঁজার ঠাই থেকে তাকে উচ্ছেদ না করে, অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিকল্পনা এবং সকলের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করে সৃষ্টিশীল পরিকল্পনার মাধ্যমে নগরের বসবাসযোগ্যতা এবং জীবনযাত্রার মান বাড়ানো যায়। উড়ালপথের মাধ্যমে সৃষ্ট নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগের উপায়কে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না করেই এমনটা করা সম্ভব। উন্নত বিশ্বে এখন নগর প্রশাসন, পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি ও নগর-সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এমন ধারণা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
এইচ এম কাদের.সিএনএন বাংলা২৪