ই-পেপার | বৃহস্পতিবার , ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শুধু ভাত খেয়ে বেঁচে থাকা; কৃষকের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন নেই

মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ময়মনসিংহ:

শুধুমাত্র ৩ বেলা ভাত খেয়ে বেঁচে থাকাই কি কৃষকের খাদ্য নিরাপত্তা? বছরের পর বছর ধান চাষ করেও কৃষক কোনো লাভ করতে পারছে না। গত ৫ বছরে ধান চাষের খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ, কিন্তু সেই তুলনায় ধানের ফলন ও উৎপাদন বেড়েছে খুব নগণ্য হারে।

 

ধান চাষে কৃষক কোনো লাভ করতে পারছে না, তাহলে কৃষক কেন ধান চাষ করবে? উচ্চপদস্থ অনেক কৃষি কর্মকর্তা এই প্রশ্নের একটা নির্লজ্জ উত্তর দেন, ‘কৃষক লাভ না হলেও ধান চাষ করবে, কারণ তাকে ভাত খেয়েই বেঁচে থাকতে হবে। কৃষক ধান চাষ করবে, কারণ এটা তার পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। ধান চাষ তাদের ঐতিহ্যবাহী পেশা।’

 

কৃষি কর্মকর্তাদের এই উত্তর কি গ্রহণযোগ্য বলে আপনি মনে করেন? খাদ্য নিরাপত্তা বলতে শুধু ভাত খেয়ে বেঁচে থাকা নয়, সেটা বোঝার জন্য কাউকে বিশেষজ্ঞ বা গবেষক হতে হয় না। খুব সাধারণ কথায়, খাদ্য নিরাপত্তা মানে শরীরের চাহিদা অনুযায়ী সব পুষ্টিকর খাবারের সহজলভ্যতা, যা থেকে কৃষক নিয়মিতভাবেই বঞ্চিত হচ্ছে।

 

শুধু কি তাই? ভাতের সঙ্গে অন্য যেসব পুষ্টিকর খাবার, শাক-সবজি, দুধ, ডিমসহ সবকিছুর দাম প্রথমে করোনা এবং পরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে দ্বিগুণ বেড়েছে। ফলে, হাজারো নিম্ন আয়ের কৃষক তাদের খাদ্য তালিকা ছোট করতে বাধ্য হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে অনেকেই কম কিনছে এবং কম খাচ্ছে। ফলে যে কৃষককে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে হয়, সেই কৃষকের শরীর দিন দিন অপুষ্ট হচ্ছে। সঙ্গে তার পরিবারের সবাই পুষ্টিকর খাবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

অথচ যে পুষ্টিকর খাবার কৃষক নিজে উৎপাদন করছেন, টাকার অভাবে কৃষক ও তার পরিবারের সদস্যরা সেই খাবার খেতে পারছেন না। ২ মণ ধান বিক্রি করে ১ কেজি ইলিশ মাছ খাওয়ার সামর্থ্য কয়জন কৃষকের আছে? অথবা ১ মণ ধান বেঁচে ১ কেজি মাংস কৃষক বছরে কয়দিন কিনতে পারে?

বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে কৃষক আরও অসহায় হয়ে পড়েছে। ধান বীজ, জমি চাষ, সেচ, সার, কীটনাশক, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, ধান কাটা শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির কারণে কৃষকের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ধান চাষের জন্য কৃষকের যা যা প্রয়োজন, তার সবকিছুই কৃষকে কিনতে হয় চড়া মূল্যে।

রোদ পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে সারা বছর শ্রম দেন কৃষক। অথচ যখন তিনি ধান বিক্রি করতে যান, তখন উপযুক্ত দাম পান না। কৃষকের এই নীরব সংগ্রাম নিয়ে কোথাও আলোচনা নেই। কৃষকের হাত শক্ত করে ধরার কেউ নেই। যুগ যুগ ধরে ধান চাষ করে কৃষকের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন নেই।

সেই হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বিঘায় (৩৩ দশমিক) আমন ধান উৎপাদনে খরচ ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৬০৭ টাকা, যার ফলন ধরা হয়েছে ৬১৭ কেজি (প্রায় ১৫ দশমিক ৫ মণ)। বর্তমান সরকারি দামে কৃষক এই সাড়ে ১৫ মণ ধান বিক্রি করলে পাবেন ১৯ হাজার ৬৫৯ টাকা। এর মধ্যে এক বিঘা জমির খড়ের দাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ৩ হাজার টাকা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যে আরও দেখা যায়, চলমান আমন মৌসুমে প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে খরচ পড়ছে ৩০ টাকা এবং চালের খরচ প্রতি কেজি ৫০ টাকা। সেই হিসাবে ১ মণ (৪০ কেজি) ধান উৎপাদনে খরচ পড়ছে ১ হাজার ২০০ টাকা, অথচ বর্তমানে ১ কেজি ধানের দাম সরকার নির্ধারণ করেছে ২৭ টাকা, অর্থাৎ প্রতি মণ ১ হাজার ৮০ টাকা। এই দামে ধান বিক্রি করলে কৃষক প্রতি মণে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ১২০ টাকা।

এ বছর আমন মৌসুমে ১ কেজি চাল উৎপাদনের খরচ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নির্ধারণ করেছে ৫০ টাকা। সেটা মিলার (চাল কল মালিক) পর্যন্ত। এরপরে মিলারের কাছে থেকে ভোক্তা পর্যায়ে এই চালের বাজার মূল্য নির্ধারিত হতে পারে ৭৫ থেকে ৮০ টাকা। আর ৫০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত উঠতে সময় লাগবে মাত্র ৫ থেকে ১০ দিন। অর্থাৎ মাত্র ৫ থেকে ১০ দিনের মধ্যে বিভিন্ন ধাপের ব্যবসায়ীরা ১ কেজি চালকে কেন্দ্র করে কৃষকের চেয়ে অনেক বেশি টাকা মুনাফা করবে।

যদি কৃষকের কথা বাদ দিয়ে ধান চাষের সঙ্গে যুক্ত বাকিদের কথা আলোচনা করি, তাহলে দেখতে পাব যে অন্য সবাই এই ধান চাষকে কেন্দ্র করে অধিক মুনাফা লাভ করেছে। কিন্তু এই নাটকের মূল নায়ক কৃষকের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না।

যদি সার, বীজ, ডিলারের কথা চিন্তা করেন, দেখবেন তারাও মুনাফা করেছে। যদি ডিপ টিউবওয়েল, পাওয়ার টিলারের মালিকের কথা চিন্তা করেন, তারাও লাভ করছে। যদি ধান ব্যবসায়ী, চাতাল মালিক কিংবা চাল কলের মালিকের কথা চিন্তা করেন, তারাও এই ব্যবসা করে গাড়ি-বাড়ি করছে। এখন সবাই যখন ধানকে ঘিরে ব্যবসা করে মুনাফা করছে তাহলে কৃষক কেন পারছে না?

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এ বছর কমিশন ফর এগ্রিকালচারাল কস্টস অ্যান্ড প্রাইসেস (সিএসিপি) ১ কুইন্টাল (১০০ কেজি) আমন ধান উৎপাদনে খরচ দেখিয়েছে মাত্র ১ হাজার ৩৬০ রুপি এবং ১ কুইন্টাল আমন ধানের দাম ভারত সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছে ন্যূনতম ২ হাজার ৪০ রুপি। এর উদ্দেশ্য, কৃষক যেন প্রতি কুইন্টাল ধানে ৬৮০ টাকা লাভ করতে পারে।

গ্রামের ছোট ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পর্যন্ত ছেলে-মেয়েদের ভালো শিক্ষা নিশ্চিত করতে শহরে পাঠাচ্ছেন। অনেক সময় তারা নিজেরাও ছেলে-মেয়েদেরকে নিয়ে জেলা বা উপজেলা শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছেন। কিন্তু খোঁজ নিলে দেখা যাবে, গ্রামের প্রান্তিক কৃষক তা পারছেন না। কারণ তার তেমন আয় নেই। তার কৃষি ছাড়া তার অন্য কোনো আয়ের সুযোগ নেই।

কৃষক কেন ধান চাষে লাভবান হতে পারছে না—এই প্রশ্নের উত্তরে গবেষকরা বলছেন, ধান চাষের জন্য যেসব উপকরণ লাগে, শ্রম ছাড়া তার প্রায় সবটুকুই নিয়ন্ত্রণ করে ব্যবসায়ীরা। ফলে কৃষকের লাভ-লোকসান নিয়ে কেউ চিন্তা করে না। অন্যদিকে ধানের দামও নির্ধারণ করে সরকার। বাজার ব্যবস্থাও ব্যবসায়ীদের হাতে। ফলে কৃষক তার উৎপাদিত ধানের ন্যায্য মূল্য না পেলেও ধান থেকে অন্যরা লাভবান হয়।

দেশের রাজনীতিতে কৃষকের কোনো মতামত দেওয়ার সুযোগ নেই। বর্তমানে রাজনৈতিক দলে কৃষকের কোনো পার্টি বা সংগঠন নেই। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পলিসি কৃষক ছাড়াই সম্পূর্ণ হয়ে থাকে। কৃষকের মতামত, সুবিধা-অসুবিধা কোনোটিই সরকারের নীতি নির্ধারণ পর্যায়ে পৌঁছায় না।

‘সার-ডিজেলের দাম বাড়লেও ধানের দাম বাড়ে নাই’ দেশের একটি অন্যতম প্রধান বীজ কোম্পানি সুপ্রিম সীডের চেয়ারম্যান কৃষিবিদ মোহাম্মেদ মাসুম জানান, দেশে হাইব্রিড ধানের বীজের যে বাজার, তার ৯৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে বেসরকারি খাত। সরকারের উচিত একটি উচ্চ মানের হাইব্রিড গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, যা বেসরকারি বাজারে আসা বীজ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে। এতে করে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমে আসবে এবং ধানের উৎপাদন বাড়বে। ধানের উৎপাদন বাড়ানো ছাড়া কৃষক লাভবান হতে পারবে না।

অন্যদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, কৃষি ক্ষেত্রে শুধু ভর্তুকি এবং সামান্য প্রণোদনা দিলেই কৃষকের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে না। কারণ বাংলাদেশের কৃষক একটি কাঠামোগত সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। কৃষককে লাভবান করতে হলে রাজনৈতিক স্বদিচ্ছার প্রয়োজন। ধান উৎপাদনের উপকরণ সুলভ মূল্য কৃষকের কাছে দিতে হবে এবং ধানের উপযুক্ত মূল্য নির্ধারণ করে দিতে হবে, যাতে কৃষক লাভবান হতে পারে। আগে কৃষকের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে ধান চাষে কৃষক দিন দিন আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে এবং দেশ খাদ্য নিরাপত্তার অধিক ঝুঁকিতে পারবে।