সালেহ আহমদ (স’লিপক):
সৈয়দ মাসুম বৃটেন প্রবাসী বাংলা সাহিত্যের একজন সফল কবি ও গবেষক এবং শমশেরনগর হাসপাতাল নির্বাহী কমিটির সভাপতি মন্ডলীর সদস্য।
সম্প্রতি শমশেরনগর হাসপাতালের রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্তি ও আউটডোর কার্যক্রম শুরুর প্রেক্ষিতে বিলেত প্রবাসী দাতা সদস্যদের সাথে কমিউনিটি নেতৃবৃন্দের বৈঠকে সৈয়দ মাসুম এর লিখিত স্বাগত বক্তব্যটির সাবলীল ও চমৎকার উপস্থাপন আগত অতিথি ও দর্শকশ্রুতাদের আকৃষ্ট করে।
বক্তব্যটিতে শমশেরনগর হাসপাতালে সূচনালগ্ন এবং এই অঞ্চলের তথা কমলগঞ্জ উপজেলা ও আশপাশ এলাকার অনেক ঐতিহাসিক তথ্যভিত্তিক ঘটনা চমৎকারভাবে তোলে ধরেছেন। যা আমাদের আগামী প্রজন্মের অনেকের জন্য শিক্ষনীয়।
সৈয়দ মাসুম শমশেরনগর হাসপাতালের সূচনালগ্ন থেকে নিরলস প্রচেষ্টায় কাজ করে যাচ্ছেন। তাই হাসপাতাল নিয়ে তাঁর লিখিত বক্তব্যটি এতোটাই প্রাণোবন্ত হয়েছে; সত্যিই তিনি প্রশংসার দাবিদার। তিনি যে একজন গুণীব্যক্তি এই লেখাই তাঁর পরিচয় বহন করে।
বাংলা ভাষাভাষী সুপ্রিয় পাঠকমহলের জ্ঞাতার্থে সৈয়দ মাসুম এর লিখিত স্বাগত বক্তব্যটি হুবহু তোলে ধরা হলো।
মূলবক্তব্যঃ
শমশেরনগর হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটি ইউকে কর্তৃক আয়োজিত আজকের এই সভার সম্মানিত সভাপতি, প্রধান অতিথি, সম্মানিত অতিথিবৃন্দ, লন্ডন ও লন্ডনের আশপাশ এলাকা ছাড়াও বার্মিংহাম, ম্যানচেষ্টার, কার্ডিফ সহ ব্রিটেনের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত শমশেরনগর হাসপাতালের দাতা সদস্য ও শুভানুধ্যায়ীগণ আসসালামু আলাইকুম।
শমশেরনগর মৌলভীবাজার জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ উপজেলা কমলগঞ্জের প্রাকৃতিক রূপ ও লাবণ্যে ভরা নন্দিত এক জনপদ। ফল ফসল আর চা বাগানে আচ্ছাদিত এই জনপদের মানুষরা ব্রিটিশ ও ব্রিটিশপূর্ব যুগে এতদঞ্চলের সম্ভাবনাময় এলাকা হিসাবেই সকলের নিকট পরিচিত ছিল। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, বার ভূঁইয়াদের অন্যতম খাজা ওসমান খান লোহানী শমশেরনগরের অদূরে পতনঊষারকে রাজধানী করে তরফ ও ইটা রাজ্যের সমন্বয়ে ওসমানগড় রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সম্ভাব্য জাপানি আক্রমন থেকে পূর্ব ভারতকে রক্ষা করতে ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ সরকার কলকাতার দমদম বিমান বন্দরের আদলে শমশেরনগরে গঁড়ে তোলে প্রাচ্যের অন্যতম বৃহৎ বিমানবন্দর দিলজান্দ বিমান ঘাঁটি। আসাম থেকে ত্রিপুরা কিংবা ত্রিপুরা থেকে আসাম তথা বাংলা ও পূর্ব ভারতের অন্যান্য এলাকার মধ্যে এক সময় সেতুবন্ধ হিসাবে কাজ করত এই এলাকা।
দুঃখের বিষয় ১৯৪৭ সালের দেশভাগ শুধু শমশেরনগর নয়, পুরো কমলগঞ্জ উপজেলা তথা দক্ষিণ সিলেটের এক বিস্তীর্ণ এলাকার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। সীমান্তবর্তী এলাকায় পরিণত হওয়ায় দ্রুত শমশেরনগর তাঁর উন্নয়ন কর্মকান্ডের যৌবনত্ব হাঁরায়। চারশত বছর আগে যে এলাকায় রাজধানী স্থাপন করে সরাইল থেকে ফেঞ্চুগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা শাসিত হত, ৮০ বছর পূর্বে গুরুত্ব ও ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনা করে যেখানে ব্রিটিশরা বিমানবন্দর স্থাপন করে, দুঃখের বিষয় ব্রিটিশমুক্ত হওয়ার পঁচাত্তর বছর আর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের তেপ্পান্ন বছরেও এই এলাকায় সর্বসাধারনের জন্য একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
দেশ সেরা পর্যটন এলাকা লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, হামহাম জলপ্রপাত, মাধবকুন্ড লেক, প্রকৃতির অপরূপ রূপে সজ্জিত ১৮টি চা বাগান, চা শ্রমিক, মনিপুরী, খাসিয়া আর বাঙালি এবং অবাঙালি মানুষের সহাবস্থান শমশেরনগর তথা সমগ্র কমলগঞ্জ উপজেলাকে এক অনন্য উচ্চতা দান করেছে। কবি বলেন, এই এলাকায় আসলে নাকি মানুষ কবি না হয়েও কবিতা লেখা শুরু করে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে শমশেরনগরের মানুষের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। ৭১ এর ৫ই মার্চ এই এলাকার দামাল ছেলেরা পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেয়। ঘটনার জের হিসাবে পাক সেনারা ২৭শে মার্চ সিরাজুল ইসলাম নামের জনৈক ব্যক্তিকে শমশেরনগরে হত্যা করে। ২৮শে মার্চ ঘটনার প্রতিবাদে শমশেরনগরে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা পন্ড করতে ঐ দিন কমলগঞ্জ সদর থেকে একদল সৈন্য শমশেরনগর অভিমুখে রওয়ানা দেয়। শমশেরনগরের জনগণ পথিমধ্যে এম্বুশ স্থাপন করে পাক সেনার বহরটিকে ফাঁদে ফেলে ক্যাপ্টেন গোলাম রসূল সহ বারজনকে হত্যা করে শুধু সিরাজুল ইসলাম হত্যার প্রতিশোধই নেয়নি শমশেরনগরবাসী ক্যাপ্টেন গোলাম রসূলকে হত্যার মাধ্যমে বৃহত্তর সিলেটের মধ্যে প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে।
কমলগঞ্জ উপজেলার ঐতিহাসিক জনপদ এই শমশেরনগরে বিমানবন্দর ও স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত স্থাপনা সমূহ ছাড়াও রয়েছে দেশের অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বি এ এফ শাহীন কলেজ। আছে ইসলামিক মিশন, রেলওয়ে ষ্টেশন, দেশের অন্যতম বৃহৎ বেশ কয়েকটি চা বাগান, রাবার বাগান ও সু-বিশাল বাজার। সর্বোপরি ২০ থেকে ২৫ হাজার মানুষের বসবাস এই শমশেরনগরে।
এই এলাকায় হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য শমশেরনগর এলাকার উন্নয়নের কিংবদন্তি হাজী মোহাম্মদ অস্তওয়ারের দৌহিত্র সারওয়ার জামান রানা ও উনার স্ত্রী বেগম আলেয়া জামান তাঁদের বিশাল ভূ-সম্পত্তির মধ্য থেকে ১৫১ শতক ভূমি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য দান করবেন বলে ঘোষণা দেন। তাঁদের দানকৃত জমিতে ২০২০ সালের আগষ্ট মাসে হাসপাতাল কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ও এই মহতী কাজের শুভ সূচনা করেন শমশেরনগর হাসপাতালের প্রধান পৃষ্ঠপোষক আজকের বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় কৃষিমন্ত্রী উপাধ্যক্ষ ড. আব্দুস শহীদ এম পি। সাথে সাথে তিনি সরকারের পক্ষ থেকে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে দশ লক্ষ টাকা প্রদানের ঘোষণা দেন। যে টাকা দিয়ে পরবর্তীতে মৌলভীবাজার জেলা পরিষদ কর্তৃক হাসপাতালের মূল প্রশাসনিক বিল্ডিং এর বেইজ তৈরী করা হয়।
হাসপাতাল কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এলাকার কৃতিসন্তান দেশ বরেণ্য কণ্ঠশিল্পী সেলিম চৌধুরীকে আহবায়ক করে গঠিত হয় আহবায়ক কমিটি। সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ মুজিবুর রহমান রঞ্জু, অধ্যাপক আব্দুস সালাম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পূবালী ব্যাংকের সাবেক সহকারী মহা-ব্যবস্থাপক ও সুজা মেমোরিয়াল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ সাইফুর রহমান কামরান এবং ইংল্যান্ড থেকে এই হাসপাতালের অন্যতম রূপকার মইনুল ইসলাম খান ও এ কে এম জিল্লুল হকের মত এলাকার সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিরা সম্পৃক্ত হন। একে একে এলাকা ছাড়িয়ে থানা, জেলা, বিভাগ এমনকি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। হাঁটিহাঁটি পা পা করে এগিয়ে যায় হাসপাতালের কার্যক্রম।
সম্মানিত উপস্থিতি, এই হাসপাতাল কোন ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে করা হয়নি। A Hospital for All এই স্লোগানকে ধারণ করে বীজ বপন করা হয়েছে এই মহতী কর্মের। গরিব ও অসহায়রা বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবাই পাবে না, পাশাপাশি তাঁদেরকে বিনামূল্যে প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র দেওয়া হবে। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা ঠিক ততটুকু দেবে, যতটুকু তাঁদের জন্য খরচ করা হয়েছে। এলাকার মানুষের দাবির প্রেক্ষিতে আর হাসপাতালের সাথে সম্পৃক্ত সকলের সর্বসম্মত মতামতের উপর ভিত্তি করে এই এলাকার কৃতিসন্তান বৃহত্তর সিলেটের অন্যতম বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা উপাধ্যক্ষ ড. আব্দুস শহীদ এম পি মহোদয়ের নামে হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনের নামকরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
সম্মানিত উপস্থিতি, আপনাদের দান ও অনুদানে হাসপাতাল কমপ্লেক্সের মাটি ভরাট কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে উপাধ্যক্ষ ড. আব্দুস শহীদ প্রশাসনিক ভবনের গ্রাউন্ড ফ্লোর ।একই বিল্ডিয়ে প্রথম তলা তথা ফয়জুর রহমান ফ্লোরের কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। পূবালী ব্যাংকে হাসপাতালের নামে ইতোমধ্যে ৫০লক্ষ টাকা ডিপোজিট রাখা হয়েছে। আরও ২৫লক্ষ টাকা ডিপোজিট রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এম্বুলেন্স সহ হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু করার প্রাথমিক সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে শোকরিয়া, মাসখানেক আগে আমরা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতিপত্র তথা লাইসেন্স পেয়ে গেছি।
ইতোমধ্যে হাসপাতালের প্রধান পৃষ্ঠপোষক মাননীয় কৃষি মন্ত্রী উপাধ্যক্ষ ড. আব্দুস শহীদ এম পি মহোদয় মে মাসের কোন এক সময় এসে হাসপাতালের আউটডোর কার্যক্রমের শুভ সূচনা করবেন বলে আমাদেরকে সদয় সম্মতি দিয়েছেন।
সম্মানিত উপস্থিতি, আউটডোর কার্যক্রমের জন্য এরই মধ্যে ডাক্তার, নার্স আয়া ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগদান অনেকটাই সম্পন্ন হয়েছে। পুরো হাসপাতাল কার্যক্রম সম্পন্ন হলে এই হাসপাতাল থেকে শুধু শমশেরনগর তথা কমলগঞ্জ উপজেলার মানুষই চিকিৎসা সেবা পাবেন না। নিকটবর্তী হওয়ায় কুলাউড়া উপজেলার হাজীপুর ও শরীফপুর ইউনিয়ন এবং রাজনগর উপজেলার কামারচাক ইউনিয়নের মানুষও স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণ করতে পারবেন।
সুধীবৃন্দ, এর সব কিছুই সম্ভব হয়েছে আপনাদের দোয়া, ভালোবাসা আর দান ও অনুদানের ফলে। আমরা শমশেরনগর হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটি ইউকে ও শমশেরনগর হাসপাতাল কমিটির পক্ষ থেকে আপনাদের সকলের কাছে আমাদের হৃদয় নিংড়ানো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
আমরা যারা এই হাসপাতালের সাথে সম্পৃক্ত তাঁদের কেউই তেমন একটা বিত্তশালী নয়। বিত্তশালী না হলেও আমাদের আছে শক্ত মনোভিত্তি আর লক্ষ্য বাস্তবায়নের একাগ্রতা। এই দু’টো শক্তিকে সাথে নিয়ে দৃঢ়চিত্তে আপনাদের সাথে আমরা এগিয়ে যেতে চাই। শুরুতে আপনারা যেভাবে আমাদের সাথে ছিলেন পুরো হাসপাতাল কার্যক্রম বাস্তবায়নে আগামীতেও আপনারা আমাদের সাথে থাকবেন এই আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
একদিন শমশেরনগর হাসপাতালের ইতিহাস লেখা হবে। লোকে হয়তো আপনাদের নাম ভুলে যাবে। কেউ নাম মনে রাখুক অথবা নাই রাখুক, হাসপাতালের প্রতিটি পরতে পরতে ইটের ফাৃকফোঁকরে আপনাদের কাজ, শ্রম, মেধা আর অর্থ মিশে থাকবে। চিকিৎসাসেবাপ্রাপ্ত এই এলাকার অসহায় হতদরিদ্র মানুষের দোয়ায় আর ভালোবাসায় বেঁচে থাকবেন আপনারা।
ধন্যবাদ আবারও আপনাদের সবাইকে। শমশেরনগর হাসপাতাল এগিয়ে যাক। জয় হোক কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগর এলাকার চিকিৎসা বঞ্চিত মানুষের।
সালেহ আহমদ (স’লিপক): সাংবাদিক, কবি, মিডিয়া ও প্রচার বিষয়ক সম্পাদক (বাংলাদেশ/অভ্যন্তরীন)- শমশেরনগর হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটি।