নিজস্ব প্রতিবেদক,ঢাকা:
ঢাকা: কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সার্টিফিকেট জালিয়াতির ঘটনায় ৩০ জনের তালিকা ধরে তদন্ত শুরু করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা (ডিবি) বিভাগ। তদন্তের স্বার্থে যাদের নাম এসেছে তাদের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হবে ডিবি কার্যালয়ে।
তালিকার মধ্যে থাকা ব্যক্তিদের কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে ডিবি।
গোয়েন্দা পুলিশের তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, শুধু কারিগরি শিক্ষা বোর্ড নয়, এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত আছেন সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের লোকজনও। এ ঘটনায় জড়িতদের মধ্যে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় নাম কারিগরি বোর্ডের সদ্য অব্যাহতিপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. আলী আকবর ও তার স্ত্রী মোছা. সেহেলা পারভীন (৫৪)। এরই মধ্যে এই অভিযোগে মোছা. সেহেলা পারভীনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি।
কর্মকর্তারা বলছেন, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কারিগরি বোর্ডের সদ্য অব্যাহতিপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. আলী আকবরকে ডিবি কার্যালয়ে ডাকা হয়েছে। মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে ডিবি। জিজ্ঞাসাবাদে তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাকেও গ্রেপ্তার করা হতে পারে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আরও বলছেন, যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন তারাই শুধু এই সার্টিফিকেট জালিয়াতি কাজের সঙ্গে জড়িত নন। তাদের বাইরেও এই জালিয়াতির সঙ্গে আরও বড় রাঘববোয়াল জড়িত রয়েছেন। তাদের তালিকা করা হচ্ছে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালকসহ অন্তত আরও ৩০ জন এই সার্টিফিকেট জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের বিষয়ে তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। দ্রুত তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা (ডিবি-লালবাগ) বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. মশিউর রহমান বলেন, সার্টিফিকেট জালিয়াতির বিষয়ে তদন্ত চলছে। এখানে আমাদের আরও কিছু কাজ বাকি রয়েছে। এ ঘটনার তদন্তে যারা জড়িত আছেন তাদের তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। তালিকায় থাকা যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে তাদের দ্রুতই গ্রেপ্তার করা হবে।
রাজধানীর মিরপুর মডেল থানায় দায়ের করা মামলায় এখন পর্যন্ত সার্টিফিকেট জালিয়াতি চক্রের মূলহোতা এ কে এম শামসুজ্জামান। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের কম্পিউটার সেলের সিস্টেম অ্যানালিস্ট এ কে এম শামসুজ্জামান, তার ব্যক্তিগত সহকারী ফয়সাল, কুষ্টিয়া গড়াই সার্ভে ইনস্টিটিউটের পরিচালক সানজিদা আক্তার কলি, কামরাঙ্গীরচর হিলফুল ফুযুল টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিএম কলেজের অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান ও ঢাকা টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিচালক মো.মাকসুদুর রহমান ওরফে মামুনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবির লালবাগ বিভাগ।
তদন্তে এসেছে যাদের নাম
তদন্ত সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সূত্র জানায়, বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সার্টিফিকেট জালিয়াতির সঙ্গে বোর্ডের সদ্য অব্যাহতিপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে এ ঘটনার সঙ্গে শুধু এই ছয়জনই জড়িত নন। বোর্ডের আরও বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা এই সার্টিফিকেট জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। সার্টিফিকেট জালিয়াতির সঙ্গে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আরও তিন কর্মকর্তার নাম পাওয়া গেছে। তারা হলেন- বোর্ডের সিবিএ নেতা আব্দুল বাছের, রেজিস্ট্রেশন শাখার অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রামার মামুনুর রশীদ ও বোর্ডের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক জাকারিয়া আব্বাস। তারা বিভিন্ন সময় বোর্ডের কম্পিউটার সেলের সিস্টেম অ্যানালিস্ট এ কে এম শামসুজ্জামানকে শিক্ষার্থীদের রেজাল্ট পরিবর্তন ও জাল সার্টিফিকেট তৈরি করার কথা বলতেন। তাদের দাবি অনুযায়ী, শামসুজ্জামান সার্টিফিকেট তৈরি করে দিতেন এবং রেজাল্ট পরিবর্তন করে দিতেন। তবে এজন্য তারা শামসুজ্জামানকে কোনো টাকা দিতেন না। একই বোর্ডের লোক হওয়ায় শামসুজ্জামান তাদের কাছে টাকা চাইতে সাহস পেতেন না।
তদন্তে সূত্রে আরও জানা যায়, শুধু তিন জন নয় বোর্ডের আরও অনেক কর্মকর্তা এই সার্টিফিকেট জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। তাদের নাম জানার জন্যও ডিবি তদন্ত করছে।
নাম এসেছে দুই দুদক কর্মকর্তার
ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, সার্টিফিকেট জালিয়াতির সঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দুই জন উপ-পরিচালকের নাম উঠে এসেছে। তারা চক্রের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে সার্টিফিকেট জালিয়াতির মামলায় এই ঘটনার মূলহোতা শামসুজ্জামানকে অব্যাহতি দিয়েছেন।
শামসুজ্জামানের সার্টিফিকেট দুর্নীতি সংক্রান্ত একটি মামলা হয় দুদকে। দুদকের উপ-পরিচালক পদ মর্যাদার এক কর্মকর্তা মামলার তদন্তের জন্য শামসুজ্জামানকে ডাকেন। এরপর থেকে দুদকের ওই কর্মকর্তাকে বিভিন্নভাবে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন শামসুজ্জামান। কিন্তু সেই কর্মকর্তাকে ম্যানেজ না করতে পেরে দুদকের উপ-পরিচালক পদ মর্যাদার আরেক কর্মকর্তার দ্বারস্থ হন শামসুজ্জামান। সেই কর্মকর্তা শামসুজ্জামানকে তার বাড্ডার বাসায় ডেকে নেন। ওই কর্মকর্তা শামসুজ্জামানকে বলেন, এখন যে কর্মকর্তার কাছে মামলার তদন্ত আছে তাকে ম্যানেজ করা যাবে না। তাই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করতে হবে, এজন্য দুদকের এই কর্মকর্তাকে ৩০ লাখ টাকা দিতে হবে শামসুজ্জামানকে। শামসুজ্জামান ওই কর্মকর্তার দাবি অনুযায়ী, ৩০ লাখ টাকার ডলার কিনে তাকে দেন। টাকা দেওয়ার পর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়। এদিকে, নতুন তদন্ত কর্মকর্তাও দুদকের উপ-পরিচালক পদ মর্যাদার আরেক জন। তিনি প্রায় ১০ লাখ টাকার বেশি টাকা শামসুজ্জামানের কাছ থেকে নিয়ে তাকে দুদকের মামলা থেকে অব্যহতি দেন।
সার্টিফিকেটের আসল কাগজ সংগ্রহ করতে শামসুজ্জামান
গ্রেপ্তারের পর গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে শামসুজ্জামান জানান, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সার্টিফিকেট কাগজ প্রতি বান্ডেলে ৫০০টি করে থাকে। বান্ডেলে করা এসব কাগজ শামসুজ্জামান শিক্ষা বোর্ডের অফিস থেকে সংগ্রহ করতেন। তবে তার কাছে জাল সার্টিফিকেট তৈরির এত চাহিদা থাকতো যে বোর্ড অফিসের কাগজ পর্যাপ্ত হতো না। কাগজের জোগান ঠিক রাখতে পুরান ঢাকা ও রংপুরের একটি প্রেসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাদের আসলে কাগজের নমুনা দেখানোর পর তারা হুবহু সার্টিফিকেটের কাগজ তৈরি করে দিতেন শামসুজ্জামানকে।
এরপর শামসুজ্জামান প্রতিদিন অফিস শেষ করে বাসায় গিয়ে এসব কাগজ দিয়ে জাল সার্টিফিকেট তৈরি করতেন। এসব জাল সার্টিফিকেট প্রিন্ট করার কাজটি করতেন তার ব্যক্তিগত সহকারী ফয়সাল। এসব সার্টিফিকেট প্রিন্ট করার জন্য রাজধানীর পীরেরবাগ এলাকায় একটি বাসা ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। তারপর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইটে গিয়ে এসব জাল সার্টিফিকেট আপলোড করে দিতেন শামসুজ্জামান। আপলোড করার পর এসব জাল সার্টিফিকেট পৃথিবীর যে কোনো জায়গা থেকে ভেরিফিকেশন (যাচাই) করা যেতো।
জিজ্ঞাসাবাদে শামসুজ্জামান জানান, তিনি ২০১৪ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এই জাল সার্টিফিকেট তৈরি করা শেখেন। মোহাম্মদ শামসুল আলম নামে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সিস্টেম সিস্টেম অ্যানালিস্টের কাছ থেকে এই জালিয়াতি শিখেছেন তিনি। শামসুল আলম বিভিন্ন সময় ডিপ্লোমা পরীক্ষার সার্টিফিকেট জালিয়াতি করতেন। শামসুল আলমও শিক্ষার্থীদের কাছে জাল সার্টিফিকেট বিক্রি করতেন। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পরীক্ষায় যেসব শিক্ষার্থীরা পাস করতে পারতেন না, তাদের নম্বর বাড়িয়ে দিয়ে পাস করিয়ে দিতেন শামসুল হোক। শামসুল হকের কাছ থেকে শিখে শামসুজ্জামান এসএসসি ও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পরীক্ষার্থীদের জাল সার্টিফিকেট বানানোসহ পরীক্ষার প্রাপ্ত নম্বর বাড়িয়ে দিতেন।
জাল সার্টিফিকেট প্রতিটি বিক্রি হতো ৩০-৫০ হাজার টাকায়
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, শিক্ষার্থীরা প্রথমে দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করতো। দালালরা শমসুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করতো। পরে সেই অনুযায়ী শামসুজ্জামান জাল সার্টিফিকেট তৈরি করতেন। জাল সার্টিফিকেট প্রতিটিতে ৩০-৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিতে শামসুজ্জামান। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালকরাও যোগাযোগ করতেন তার সঙ্গে। পরিচালকরা সার্টিফিকেটপ্রতি ৩০-৫০ হাজার টাকা দিলেও তারা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আরও মোটা অংকের টাকা নিতেন। প্রায় ৩০ জনের মতো দালাল ও পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে গ্রেপ্তার শামসুজ্জামানের। নরসিংদী, ময়মনসিংহ, খুলনা, দিনাজপুর, গাজীপুর, ঢাকা ও কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার দালালরা ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা শামসুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন।
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর-রশীদ বলেন, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আলী আকবর খানকে রোববার (২১ এপ্রিল) ওএসডি করা হয়েছে। মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে ডিবি কার্যালয়ে ডাকা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাকেও গ্রেপ্তার করা হবে। এ ঘটনায় যাদের নাম এসেছে পর্যায়ক্রমে সবাইকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।