সেলিম উদ্দীন,কক্সবাজার :
দেশের চাহিদা মাথায় রেখে উপকূলীয় অঞ্চলের চাষিরা পুরোদমে লবণ উৎপাদন করছেন। কক্সবাজার সদর, ঈদগাঁও, মহেশখালী, চকরিয়া, টেকনাফ, কুতুবদিয়া, পেকুয়া ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় ৬৬ হাজার ৪ শত ২৪ একর জমিতে লবণ উৎপাদিত হচ্ছে। এসব মাঠে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫ লাখ ৪৫ হাজার মেট্রিক টন। গেলো চার মাস তথা এপ্রিল পর্যন্ত লবণ উৎপাদিত হয়েছে ১৭ লাখ মেট্রিক টন।
চট্টগ্রামের বাঁশখালীসহ কক্সবাজারের ৮ উপজেলার ৪১ হাজার ৭৬৫ জন লবণ চাষি নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে লবণ মাঠে নেমেছেন। অবশ্যই কোনো কোনো এলাকা বিশেষ করে কুতুবদিয়া, মহেশখালী ও পেকুয়ার লবণ চাষিরা গেলো বছরের শেষদিকে মাঠে নেমেছেন।
চাষিরা বলছেন, বৃষ্টিপাত না থাকায় বা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হওয়ায় এতো বেশি লবণ উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। যে জমিতে লবণ উৎপাদন হয় সেই একই জমিতে বর্ষা মৌসুমে বাগদা চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষ হয়। কিছু কিছু জমিতে ধানও উৎপাদন হয়।
আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে চাষিরা এ বছর টার্গেট অতিক্রম করতে পারবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন কক্সবাজার লবণ উৎপাদনকারী সমিতির সভাপতি মোস্তফা কামাল চৌধুরী।
চলতি মৌসুমের শুরুতেই মাঠ পর্যায়ে লবণের দাম ভালো থাকায় ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে লবণ চাষে নেমেছেন চাষিরা। চলতি মৌসুমে ৬৬ হাজার ৪২৪ একর জমিতে লবণ চাষ করছেন চাষিরা। তবে তাদের আশঙ্কা, বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করা হলে তারা যথাযথ দাম পাবেন না। সেক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন চাষিরা। ভবিষ্যতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে।
এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের উচ্চ পর্যায়ে একটি মধ্যস্বত্বভোগী গোষ্ঠী ভুল বুঝিয়ে লবণ আমদানি করে দেশের চরম ক্ষতি করছে। ফলে ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিয়ে লবণ চাষিদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সরেজমিন কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, চাষিরা কোমর বেঁধে মাঠে কাজ করছেন। বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রচন্ড রোদের মধ্যে কাজ করেও তাদের চেহারায় তেমন ক্লান্তির ছাপ নেই।
চাষি ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে লবণ উৎপাদনের ক্ষেত্র হচ্ছে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী। এসব এলাকায় উৎপাদিত লবণ দিয়ে সারা দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব।
টেকনাফ-কক্সবাজার সদরের খুরুশকুলসহ উপকূলীয় এলাকায় লবণ চাষিরা বলছেন, দেশে যথেষ্ট পরিমাণ লবণ উৎপাদন হয়। তারাও তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাদের দাবি, কোনোভাবেই যেনো লবণ আমদানি করা না হয়।
মহেশখালী লবণ চাষি সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট শাহাবুদ্দীন জানান, দেশে প্রচুর লবণ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। চাষিদের সরকারিভাবে ঋণ দেয়ার মাধ্যমে পৃষ্ঠপোষকতা করা হলে উৎপাদন আরও বাড়বে। এতে সরকারেরও বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পাওয়ার সুযোগও তৈরি হবে।
বিসিক সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ মৌসুমে দেশে লবণের চাহিদা ২৫ দশমিক ২৮ লাখ টন। মৌসুমের শুরুতে মাঠ পর্যায়ে মজুত রয়েছে ১ দশমিক ৬০ লাখ মেট্রিক টন। ২০২২-২৩ মৌসুমে চাহিদা ছিল ২৩ দশমিক ৮৫ লাখ টন। ওই মৌসুমে উৎপাদন হয় ২২ লাখ ৩২ হাজার ৮৯০ মেট্রিক টন। ২০২৩-২৪ মৌসুমে লবণের মূল্য ধরা হয়েছে মণ প্রতি ৫২৬ টাকা এবং টন প্রতি ১৩ হাজার ১৪৬ টাকা। তবে চাষিরা বলছেন, প্রতি মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৩৬০ টাকায়।
এছাড়া বৃহৎ লবণ কেন্দ্র রয়েছে কুতুবদিয়ার লেমশিখালী, উত্তর নলবিলা, মহেশখালীর গোরকঘাটা, মাতারবাড়ি, ঈদগাঁওর গোমাতলি, পেকুয়ার দরবেশকাটা, চকরিয়ার ডুলাহাজারা ও ফুলছড়ি, টেকনাফ, বাঁশখালীর পূর্ব বড়ঘোনায়।
লবণ শিল্পের উন্নয়ন কার্যালয় কক্সবাজারের পরিদর্শক (উন্নয়ন) মো. ইদ্রিস আলী জানান, নভেম্বরের শুরু থেকে মাছ চাষ, কাঁকড়া চাষ ও ধানের চাষ প্রায় শেষ হয়। এরপর থেকে চাষিরা লবণ উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত। বৃষ্টি না হলে এবং আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে তারা আরও উপকৃত হবেন।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র কুটির শিল্প কর্পোরেশনের লবণ শিল্প উন্নয়ন প্রকল্পের (বিসিক) উপ মহাব্যবস্থাপক জাফর ইকবাল ভূঁইয়া বলেন, যে জমিতে আগে ১২ থেকে ১৩ লাখ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন হতো, আর সেই একই জমিতে এখন ২৫ লাখ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদনের টার্গেট নিয়ে চাষিরা মাঠে কাজ করছেন। এর কারণ আগে সনাতন প্রযুক্তিতে কাঁদা লবণ উৎপাদন হতো মাঠে। আমরা চাষিদের সেখান থেকে বের করে আধুনিক পলিথিন প্রযুক্তিতে সাদা লবণ উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছি। সামনে আরও সুখবর আসছে লবণ উৎপাদনে।
তিনি আরও বলেন, কক্সবাজারের চৌফলদন্ডীতে হচ্ছে বঙ্গবন্ধু লবণ গবেষণা ইনস্টিটিউট। এতে কীভাবে আরও সর্বাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে সারা বছর লবণ উৎপাদন করা যায় সে বিষয়ে কাজ চলছে। আগামীতে আরও নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্বল্প ব্যয়ে ও কম সংখ্যক মানুষকে কাজে লাগিয়ে বেশি লবণ উৎপাদনে আমরা আশাবাদী। তবে উৎপাদন বেশি হওয়ায় এবং অনুকূল আবহাওয়া বিরাজ করায় লবণের দাম কমতে পারে।
এদিকে, অপ্রয়োজনে লবণ আমদানি বন্ধ করে দেশি লবনের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন কক্সবাজারের লবণ চাষী সমিতির নেতারা। মাঠ পর্যায়ে লবণের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ এবং অপ্রয়োজনে লবণ আমদানি বন্ধ রাখার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানান, লবণ চাষী কল্যাণ পরিষদ সভাপতি মোস্তফা কামাল চৌধুরী, লবণ চাষী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সাহাব উদ্দিন ও লবণ চাষী ঐক্য পরিষদের সভাপতি শরীফ বাদশা।