ই-পেপার | শনিবার , ২রা নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ৭শ’বছরেরঐতিহ্যবাহী শাহ মোহছেন ’আউলিয়া’র বার্ষিক ওরশ আজ

বিশেষ প্রতিবেদন:

শাহ্ সূফি মোহছেন আউলিয়ার মাজারের বার্ষিক ওরশ’ চট্টগ্রামের আনোয়ারায় দুদিনব্যাপী ওরশ মোবারক মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হচ্ছে আজ দরবার প্রাঙ্গণে। ভক্তদের কাছে তিনি মোহছেন আউলিয়া (রহ.)বা ‘মোছন’আউলিয়া নামে অধিক পরিচিত।

আজ সোমবার (২০জুন)২৩ইং,৬ আষাঢ় দরগাহ প্রাঙ্গনে মোহছেন আউলিয়া (রহঃ) ওরশ শরীফ অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
এতে ভক্ত সমাগমদের প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও ওরশ সফল করার আহ্বান জানান দরগাহ পারিচালনা কমিটি।

প্রতি বছর বার্ষিক ওরশ’কে ঘিরে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বটতলী ইউনিয়নের বরুমহাট দরগাহে ভক্তরা কোরআনখানি,মিলাদ মাহফিল ও তবারক বিতরণের মধ্য দিয়ে নানান কর্মসূচি পালনের মধ্যে দিয়ে ওরশ শরীফ উদযাপন করেছে।ওরশে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লাখ লাখ ভক্তগণ দরবারে সমবেত হন।

জানা যায়,হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কর্তৃক ইসলাম ধর্ম প্রচারিত এবং প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সাহাবী,পীর,আউলিয়া,ফকির, দরবেশগণ সারা পৃথিবীতে ইসলাম প্রচার এবং প্রতিষ্ঠিত করেন।

সুদূর আরব থেকে চট্টগ্রামে আগত পীর আউলিয়া, ফকির, দরবেশগণের মধ্যে মহান বুজুর্গ অলী হযরত শাহ মোহছেন আউলিয়া অন্যতম। হযরত শাহ মোহছেন আউলিয়া (রহঃ) ৮৮৬ হিজরী ৭২ বাংলা ১৪৬৬ সনে জন্ম গ্রহণ করেন।তিনি কখন বাংলাদেশে আগমন করেন তার ইতিবৃত্ত জানা যায়নি।তবে,তিনি প্রখ্যাত পীর হযরত বদর শাহ (রহঃ) সাথে চট্টগ্রামে আগমন করেছিলেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে।

 

হযরত শাহ মোহছেন আউলিয়ার (রহঃ) আদি নিবাস ইয়েমেনে। তাঁর পূর্ব পুরুষের পরিচয় জানা না গেলেও বিভিন্ন ইসলামী চিন্তাবিদদের মতে তিনি একজন সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান ছিলেন। ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তিনি ইসলাম প্রচারে নেমে যান।

তিনি ইয়েমেন থেকে প্রথমে ভারতে গৌড় রাজ্যে আগমন করেন। গৌড়রাজ্য তখন শিক্ষা, শিল্প সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল। গৌড়রাজ্যে কিছুদিন অবস্থান করার পর হযরত শাহ মোহছেন আউলিয়া পানি পথে চট্টগ্রামে আগমন করেন।

 

কথিত আছে তিনি তাঁর ব্যবহৃত পাথরকে কিস্তি বানিয়ে পানি পথে চট্টগ্রামে আগমন করেন। তিনি চট্টগ্রামে এসে কর্ণফুলী নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত দেয়াং এর পাহাড়ে আস্তানা গাড়েন।দেয়াং এর পাহাড়ে অবস্থান করে তিনি চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে থাকেন। তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা এবং মোহনীয় শক্তি সবাইকে মোহিত করত।তার অলৌকিক ঘটনা সম্পর্কে লোকমুখে জানা যায়, কোন একদিন নিঝুম নির্জন গ্রামের মাঠে এক বোবা ছেলে গরু, ছাগল দেখা শোনা করছিল।

মোহছেন আউলিয়া (রহঃ) ঐ ছেলেকে ডাকলেন তার সাথে কথা বলতে গিয়ে জানতে পারে ছেলেটি বোবা। এ অবস্থায় তিনি বোবা ছেলের মুখে তার পবিত্র হাত মোবারক রাখলেন তখন সাথে সাথে ছেলেটি কথা বলতে আরম্ভ করল।তিনি ছেলেটিকে বলল যাও, তোমার পিতা-মাতাকে ডেকে নিয়ে আস।

সে তার বাড়িতে গিয়ে কথা বলতে পারলে আশ্চার্য হয়ে মাতা-পিতা ও পাড়া প্রতিবেশীরা সবাই বাবাজান কেবলার কাছে এসে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন এবং তাকে থাকার ব্যবস্হা করে দেন।

 

হযরত শাহ মোহছেন আউলিয়া (রহঃ) অলৌকিক পরিচয় পাওয়ার পর সে সময় দলে দলে মানুষ এসে তাঁর কাছে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে। তিনি চট্টগ্রামে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন। অল্প সময়ের মাঝে তাঁর অসংখ্য ভক্ত এবং মুরীদ সৃষ্টি হয়। দীর্ঘ সময় চট্টগ্রাম অবস্থান করে ইসলাম ধর্ম প্রচার করে ৯৮৫ হিজরী ৯৭১ বাংলা ৬ আষাঢ় ১৫৬৫ সনে তিনি ইন্তেকাল করেন।

 

তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার ঝিউরী গ্রামে সমাধিস্থ করা হয়। তাঁর কবর শরীফ শঙ্খ নদীর তীরে অবস্থিত হওয়ায় কবর শরীফ নদীর ভাঙ্গঁনের কবলে পড়লে হযরত মোহছেন আউলিয়া (রহঃ) বড় উঠানের একজন বিশিষ্ঠ জমিদারকে স্বপ্ন যোগে জানান যে, তাঁর কবর শরীফ বটতলীতে স্থানান্তরিত করা হোক।

 

কিন্তু সেই বিশিষ্ঠ ব্যক্তি স্বপ্নের ব্যাপারটি গুরুত্ব দেয়নি।ফলে তার জমিদারি বিলুপ্ত হয় বলে শোনা যায়।

পরবর্তী পর্যায়ে বটতলীর অপর তিন ব্যক্তিকে তিনি স্বপ্নযোগে জানান, ঝিওরী গ্রামের শঙ্খ নদীর পাড়ে আমার কবর ভাঙ্গা অবস্থায় আছে, তার পার্শ্বে একটি পাথরও আছে।

তোমরা আমার কফিন ও পাথরখানা নিয়ে বটতলী গ্রামের যেখানে সুবিশাল একটি বটগাছ এবং উলুবন সমৃদ্ধ জায়গা আছে সে স্থানে দাফন কর।

ঐ তিন ব্যক্তি স্বপ্নের বিষয়টি বেশ গুরুত্ব দেন এবং স্বপ্নের আদেশ অনুযায়ী তারা এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

তারা নদীর তীরে গিয়ে দেখতে পান পাথরের ওপর একটি লাশ ভেসে আছে। তারা ঐ লাশ বটতলীতে এনে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে দাফন করে। যেখানে তাঁর লাশ দাফন করা হয় সেখানে এখন তাঁর পবিত্র মাজার শরীফ গড়ে উঠেছে।

তিনি যে পাথর খন্ড করে ভেসে এসেছিলেন তা এখনও পর্যন্ত তাঁর পবিত্র মাজার শরীফে সংরক্ষিত আছে। এই পাথরটিকে অলৌকিক পাথর বলা হয়।

বর্তমানে তার মাজার শরীফ চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বটতলী গ্রামে অবস্থিত।রোগ মুক্তি ও বড় বড় সমস্যা থেকে রক্ষা পাওয়ার লক্ষ্যে পাথরের পানি পান করেন বক্তরা।প্রতিবছর বাংলা ৬ আষাঢ় বটতলীস্থ দরগাহ প্রাঙ্গনে মোহছেন আউলিয়া (রহঃ) ওরশ শরীফ অনুষ্ঠিত হয়।ওরশে লক্ষ লক্ষ আশেক-ভক্তদের সমাগম ঘটে।মোহছেন আউলিয়া (রহঃ) চট্টগ্রামের জমিনকে ইসলামের আলোকে আলোকিত করেন।

 

বর্তমানে তাঁর নামে আনোয়ারা উপজেলার বটতলী গ্রামে স্কুল,কলেজ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত মোহছেন আউলিয়ার মাজারঃ ইয়েমেনে জন্ম নেওয়া বাংলার সুফি মতবাদের অন্যতম প্রবর্তক হযরত শাহ্ মোহছেন আউলিয়া (র.) সুদূর আরব থেকে সমুদ্রপথে চট্টগ্রামে আসেন প্রায় ৭০০ বছর আগে।

 

তাঁর প্রকৃত নাম শাহ্‌ মছনদ যাহা সুলতানি ও মোঘল আমলের শিলালিপি এবং চট্টগ্রামে প্রাপ্ত সূফী ও পীরদের তালিকার প্রাচীন আরবি পাণ্ডুলিপিও লাখেরাজ সম্পত্তি তদন্ত বিষয়ক কোর্ট প্রসিডিং এ প্রমাণিত।

প্রাচীন লেখকগণ তাকে হযরত শাহ মোছন আউলিয়া বলেন। বর্তমানে অনেকে তাকে মোহছেন বা মুহসিন আউলিয়া বলে থাকেন। তবে, তিনি কীভাবে বাংলাদেশে এসেছেন তা জানা না গেলেও; আরেক সুফি হজরত বদর শাহ (রহ.)

 

এইচ এম কাদের,সিএনএন বাংলা২৪: