ই-পেপার | শনিবার , ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

মোশাররফ হোসেন বলেন পরকীয়ার কারণে বাবুলই খুন করান মিতুকে।

চট্টগ্রাম প্রতিনিধিঃ

মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলায় গতকাল রবিবার প্রথম সাক্ষ্য দিলেন তার বাবা ও পুলিশের সাবেক পরিদর্শক মোশাররফ হোসেন। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ জসিম উদ্দিনের আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যে তিনি মিতু হত্যার কারণ সবিস্তারে তুলে ধরেন।

মোশাররফ হোসেন বলেন, খুন হওয়ার কয়েক বছর আগে মাহমুদা খানম মিতু কক্সবাজারের একটি হোটেলে তার স্বামী বাবুল আক্তার ও তার বন্ধু আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত এক নারীকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলেন। এতে বাবুল ও মিতুর দাম্পত্য সম্পর্কের অবনতি হয়। বাবুলের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মিতু একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল।

এই বিরোধের জেরে বাবুল আক্তারের পরিকল্পনা ও নির্দেশে মিতুকে খুন করা হয়। মৃত্যুর সংবাদ পেয়েই মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন তৎকালীন সিএমপি কমিশনারসহ ঊর্ধ্বতন কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে জানিয়েছিলেন, বাবুল আক্তারের ইন্ধনেই এই হত্যাকা- ঘটেছে।

মোশাররফ হোসেনের জবানবন্দি অসমাপ্ত অবস্থায় আদালত কার্যক্রম মুলতবি করে ২ মে আবারও সাক্ষ্যগ্রহণের আদেশ দেন।

রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মহানগর পিপি আবদুর রশীদ বলেন, ভিকটিম মাহমুদা খানম মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন জবানবন্দিতে পরিষ্কারভাবে বলেছেন, বাবুল আক্তারের পরিকল্পনায় এই হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে। তার বর্ণনায় বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততার বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য। ২ মে মোশাররফ হোসেন আবারও আদালতে সাক্ষ্য দেবেন।

বাবুল আক্তারের আইনজীবী কফিল উদ্দিন চৌধুরী বলেন, মোশাররফ হোসেন সাত বছর আগে পুলিশের কাছে এক কথা বলেছেন, আদালতে এসে আরেক কথা বলছেন। হত্যাকা-ের পর তিনি পুলিশকে বলেছিলেন, এর সঙ্গে বাবুল আক্তারের কোনো যোগসূত্র নেই। এখন বলছেন ভিন্ন কথা। এতে স্পষ্টভাবে প্রমাণ হয়েছে, বাবুল আক্তারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তিনি সাক্ষ্য দিয়েছেন। তার বক্তব্য ভিত্তিহীন।

দুপুর সোয়া ১২টার দিকে মোশাররফ হোসেনকে সাক্ষী হিসেবে রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে উপস্থাপন করে। মাঝে আধঘণ্টার বিরতি দিয়ে দুপুর ২টা ১৮ মিনিট পর্যন্ত চলা জবানবন্দিতে মোশাররফ মিতুর মৃত্যুর খবর পাওয়া, চট্টগ্রামে আসা, বাবুলের কর্মকা-, তাদের দাম্পত্য জীবন- এসব বিষয় বিস্তারিত তুলে ধরেন।

হত্যাকা-ের বিবরণ দিয়ে মোশাররফ হোসেন আদালতে বলেন, মাহমুদা খানম মিতু তার ছেলে আক্তার মাহমুদ মাহিরকে ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলের বাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় ভোর ৬টা ৩৩ মিনিটে জিইসি মোড়ে অজ্ঞাতনামা তিনজন সন্ত্রাসী আক্রমণ করে। এদের মধ্যে একজন (মুসা) তার হাত থেকে ছেলেকে নিয়ে যায়। অপর দুই সন্ত্রাসী ওয়াসিম ও আনোয়ার মিতুর বাম পাশের বাহুতে, পিঠে ধারালো ছুরি দিয়ে জখম করে। ওয়াসিম তার হাতে থাকা পিস্তল দিয়ে মাথার বাঁ-দিকে কপালে গুলি করে, যা ডান দিক হয়ে বের হয়ে যায়।

এ সময় মিতুর ছেলে মাহির সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে তার মায়ের প্রাণভিক্ষা চায়। মিতু মাটিতে লুটিয়ে পড়লে আসামি তিনজন ঘটনাস্থলের পূর্বপাশে রাখা মোটরসাইকেলে করে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে গোল পাহাড়ের দিকে চলে যায়। এ সময় আশপাশের অনেক দোকান বন্ধ ছিল। অপর আসামি ভোলাইয়া, কালু, শাহজাহান ও সাইফুর এক সঙ্গে ছিল। সাইফুর সবকিছু রেকি করেছিল।

বাবুল আক্তারের ভূমিকা তুলে ধরে মোশাররফ বলেন, ঘটনাস্থল ত্যাগ করার পরপরই আসামি মুসা মূল পরিকল্পনাকারী বাবুল আক্তারকে মোবাইলে কল দিয়ে জানায়। বাবুল আক্তার বলে কোপাইলি কেন? এটা তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ ও মিডিয়ার নজরে আসে। আসামিরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করার পরপরই মাহির বাসায় গিয়ে দারোয়ানকে জানায়। এরপর নিজের বাসায় গিয়ে সাততলায় পার্শ্ববর্তী এক মহিলার মোবাইলের মাধ্যমে তার মায়ের হত্যাকা-ের বিষয়ে বাবুল আক্তারকে জানায়। মাহিরের বক্তব্য অনুযায়ী, বাবুল আক্তার কল রিসিভ করে কোনো জবাব দেয়নি।

এর পরপরই মাহির তার নানি অর্থাৎ মিতুর মাকে (সাহিদা মোশাররফ) মোবাইলে কল দিয়ে জানায় যে- আমার মাকে সন্ত্রাসীরা খুন করে রাস্তার ওপর ফেলে রেখেছে। তখন আমার স্ত্রী কান্নারত অবস্থায় মাহিরকে বলে, কাপড় দিয়ে তোর মাকে ঢেকে রাখ। মাহির বাড়ি থেকে চাদর নিয়ে এসে দারোয়ানসহ গিয়ে লাশ ঢেকে রাখে।

মিতু হত্যার সংবাদ বাবুল আক্তার তাদের জানাননি অভিযোগ করে মোশাররফ বলেন, টেলিভিশন, মিডিয়ায় এবং মাহিরের কাছে সংবাদ পেয়ে আমার স্ত্রী আমার ছোট মেয়ে ডাক্তার শায়লা মোশাররফ নিনজা, ছোট ভাই শহিদুল ইসলাম, তার স্ত্রী ও আমার চাচাতো ভাইসহ বিমানযোগে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে আসে। ওই সময় আমি বরিশাল ছিলাম। বাবুল আক্তারকে র?্যাবের একটি হেলিকপ্টারে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে নেওয়া হয়। আমার স্ত্রী-মেয়েদের আগেই বাবুল আক্তার পৌঁছে যায়। আমার স্ত্রী ও তার সঙ্গের লোকজন ঘটনাস্থল ও বাবুলের বাসায় পৌঁছার আগেই লাশ সুরতহাল করে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

সিএমপি কমিশনারকে বাবুল আক্তার হত্যাকা-ে জড়িত বলে জানিয়েছিলেন- এ তথ্য দিয়ে সাক্ষ্যে মোশাররফ বলেন, আমার স্ত্রী খুনের সংবাদ পেয়ে আমাকে কল দিয়ে জানায়। আমি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বরিশাল থেকে স্পিডবোটে নোয়াখালী এবং সেখান থেকে মাইক্রোবাস নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হই। পথিমধ্যে আমি মোবাইলে পুলিশ কমিশনারসহ আরও তিন-চারজন অফিসারের কাছে চার-পাঁচবার কল করি। আমার মেয়ের খুনের ব্যাপারে তাদের জানাই, বাবুল আক্তারের ইন্ধনে এই হত্যা হয়েছে। তারা ওই মূহূর্তে ব্যস্ত থাকার কারণে আমার কথার সঠিক জবাব দেননি।

অপরাধ ঢাকতে মিতুকে শৈলকুপায় দাফনের চেষ্টা করেছিল বাবুল- এ তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, আমি চট্টগ্রাম অঞ্চলে বারইয়ারহাট এলাকায় পৌঁছার পর জানতে পারি, মিতুর জানাজা তখন চলছে। পরে জানতে পারি যে, মিতুকে নিয়ে বাবুল আক্তারের গ্রামের বাড়িতে শৈলকুপায় নিয়ে যাওয়া হবে। তখন আমি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাই, বাবুল আক্তার তার পরিকল্পিত অপরাধ ঢাকার জন্য আমার মেয়ের লাশ আমাদের না দেখিয়ে দাফন করতে নিয়ে যাচ্ছে। আমার পরিবারের লোকজন জানায়, মেয়ের বাবা ঢাকায় আছেন। সেখানে যেন লাশ নিয়ে যাওয়া হয়। লাশ নিয়ে যাওয়ার কথা শুনে আমি ঢাকায় চলে যাই।

মিতুর লাশ ঢাকার বাসায় পৌঁছার পরপরই লাশের সঙ্গে থাকা সবাই আমাদের বাসায় চলে আসে। বাবুল আক্তারও তার লোকজন নিয়ে বাসায় পৌঁছে। আনুমানিক আধঘণ্টা মিতুর লাশ বাসায় রাখা হয়। রাত ১১টার দিকে স্থানীয় বায়তুল ফালাহ জামে মসজিদে জানাজা হয়। স্থানীয় মেরাদিয়া কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।

কবরে পুলিশ পাহারা বসানো হয়েছিল জানিয়ে মোশাররফ বলেন, বাবুল আক্তার মিতুকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে সন্ত্রাসী ও জঙ্গিগোষ্ঠী তার স্ত্রীকে হত্যা করেছে এই কথা প্রচার করেছিল। এতে পুলিশ প্রশাসন সন্দিহান হয়ে পড়ে। লাশ দাফনের পর পাঁচ থেকে সাতদিন কবরে পুলিশ পাহারা ছিল। সার্বক্ষণিক আমাদের বাসায় ২০ থেকে ২৫ দিন পুলিশ পাহারা ছিল।

বাবুল আক্তার মায়াকান্না করেছিল অভিযোগ করে মোশাররফ বলেন, মিতু হত্যার পরপরই চট্টগ্রাম ও ঢাকায় বাবুল আক্তারের মায়াকান্না সিনেমার মতো সারাবিশ্বে মিডিয়াপাড়ায় তোলপাড় সৃষ্টি করে। তখনই আমাদের ধারণা হয়েছিল, সে তার অপকর্ম ঢাকার জন্য এসব অভিনয় করছে। পরের দিন অর্থাৎ ২০১৬ সালের ৬ জানুয়ারি আমাদের বাসায় বাবুল আক্তারসহ প্রশাসনের লোকজন উপস্থিত ছিল। এর মধ্যে বাবুল আক্তার আমাদের অবহিত না করে অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীদের আসামি করে নিজেই একটি মামলা দায়ের করে।

পুলিশ সদর দপ্তরের জিজ্ঞাসাবাদে বাবুল আক্তার হত্যার কথা স্বীকার করেছিল উল্লেখ করে মোশাররফ বলেন, বাবুল আক্তার আমাদের বাসায় অবস্থান করাকালে ২২, ২৩ ও ২৪ জুন সকাল ৯টা-১০টার দিকে পুলিশ অফিসাররা তাকে ঢাকার ডিবি অফিসে নিয়ে যায়। আবার সন্ধ্যায় চলে আসে। সে নভেম্বর পর্যন্ত আমাদের বাসায় ছিল। ২৪ জুন সন্ধ্যায় পুলিশ অফিসার্স ক্লাবে ইফতার পার্টি ও দোয়া অনুষ্ঠান ছিল। ওই অনুষ্ঠানে ২৪তম বিসিএস ব্যাচের পুলিশ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে রাত আনুমানিক ৯টায় বাবুল আক্তার ও তার দুই বাচ্চাসহ আমরা বাসার উদ্দেশে রওনা হই।

আমাদের পেছনে এবং সামনে পুলিশের গাড়ি ফলো করছিল। রাত আনুমানিক ১১টায় বাসায় পোঁছার পরপরই পুলিশের এসপি পদমর্যাদার ও জুনিয়র কয়েকজন কর্মকর্তা বাসায় আসেন। বাসার দোতলায় ড্রইংরুমে বসেন। বাবুল আক্তার ওই সময় পাশের বেডরুমের দুই বাচ্চাসহ অবস্থান করছিল। অফিসাররা তাকে বের হওয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করেন। পরে সে ড্রইংরুমে এলে অফিসাররা তাকে সঙ্গে যাওয়ার জন্য বলেন। আনুমানিক রাত ১১টায় তাদের সঙ্গে রওনা হয়ে যাওয়ার সময় বাসার সামনে মাহিরের নানিকে পেয়ে বলেন, আপনি মাহির, তাবাসসুমকে দেখে রাখবেন। আমি হয়তো-বা নাও আসতে পারি।

মোশাররফ আরও বলেন, ২৪ জুন রাত ১২টার পর থেকেই বাবুল আক্তারের সন্ধান জানতে সাংবাদিকরা আমাদের বাসায় জড়ো হন। আমরা শুনতে পাই, বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে তার জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। ২৫ তারিখ সন্ধ্যার পরপরই ডিবির অফিসাররা বাবুল আক্তারকে বাসায় পৌঁছে দেন। তখন আমরা বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারি বাবুল আক্তার স্বীকার করে যে- মিতু হত্যার সঙ্গে সে সম্পৃক্ত ও পরিকল্পনাকারী। মিতুকে হত্যার পরিকল্পনা করে আসামি মুসাকে টাকা দিয়ে অস্ত্র কিনে দিয়েছে।

২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে নগরীর পাঁচলাইশ থানার ও আর নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে বাসার অদূরে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে খুন করা হয় মাহমুদা খানম মিতুকে। স্ত্রীকে খুনের ঘটনায় পুলিশ সদর দপ্তরের তৎকালীন এসপি বাবুল আক্তার বাদী হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

২০২২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সাত জনকে আসামি করে আদালতে মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করে। ১০ অক্টোবর আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন। অভিযোগপত্রে প্রধান আসামি করা হয়েছে মিতুর স্বামী বাবুল আক্তারকে।