ই-পেপার | বৃহস্পতিবার , ২৭শে জুন, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ঋণের চাপ বাড়াচ্ছে আত্মহত্যা

নিজস্ব প্রতিবেদক:

 

এনজিও-মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে বহু পরিবার সম্মানবোধের জায়গা থেকে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন অনেকে, বলছেন সমাজবিজ্ঞানীরা

 

উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানসিক চাপ বাড়ছে। বাড়ছে ঋণের বোঝা। দ্রব্যমূল্য দিনে দিনে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি এখন এমন পর্যায়ে চলে যাচ্ছে, যেখানে মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তে পরিণত হচ্ছে। মানুষ এখন সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। যাদের সঞ্চয় নেই, তারা ঋণ করছে। ফলে মানুষের ওপর চাপ বেড়ে যাচ্ছে।

 

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, পরিস্থিতির উন্নতি না হলে দিনে দিনে সংকট আরও বাড়বে। সাম্প্রতিক সময়ে ঋণের চাপ সইতে না পেরে বেশ কয়েকটি পরিবারে সন্তানদের নিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে এনজিও বা মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে নিঃস্ব হয়েছে বহু পরিবার।

 

সর্বশেষ মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলায় সায়মা বেগম (৩৫) তার মেয়ে ৯ বছরের ছাইমুনা এবং সাত বছরের ছেলে তাওহীদকে নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। পুলিশের প্রাথমিক ধারণা, তিনি ঋণের চাপে আত্মহত্যা করেছেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ঋণের জ্বালা সইতে না পেরে সিরাজুল ইসলাম (৫৫) নামে ঝিনাইদহের এক ব্যবসায়ী শেষমেশ বেছে নেন আত্মহত্যার পথ। সুদের যন্ত্রণা তার হূদয় কতটা ক্ষতবিক্ষত করেছে, তা ফুটে উঠেছে জীবননাশের আগে লিখে যাওয়া চিরকুটের অক্ষরে অক্ষরে। চিরকুটে তিনি লেখেন, ‘সুদখোরদের অত্যাচারে বাঁচতে পারলাম না। আমার জায়গাজমি, বাড়ি সব বিক্রি করে দিয়েছি।

 

একেকজনের কাছ থেকে যে টাকা নেওয়া, তার সাত-আট-দশ গুণ টাকা দিয়েও রেহাই দিল না তারা। কেউ আবার কেস করেছেন, কেউ অপমান-অপদস্থ করেছেন। আমি আর সহ্য করতে পারছি না, তাই বিদায় নিলাম।’ শুধু ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম নন, আরো অনেকেই সম্প্রতি একই ধরনের আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সানেমের গবেষণা পরিচালক ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, ‘আমাদের আয় তো বাড়ছে না, কিন্তু ব্যয় তো বেড়েই চলেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে আমাদের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। অনেকে হয়তো এই অবস্থায় না গেলেও প্রচণ্ড মানসিক চাপে আছেন। এখন আমাদের ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। ফলে আমাদের ঋণ নিলে কিন্তু শোধ করতেই হয়। উন্নত দেশগুলোতে দ্রব্যমূল্য বাড়লেও স্বাভাবিক জীবনে এর খুব বেশি প্রভাব পড়ে না। এসব কারণে আমাদের দেশে অনেক বেশি সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। তরুণেরা বিপথগামী হচ্ছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। কারণ তারা হাত পাততে পারে না। ফলে তাদের সঞ্চয় ভেঙে বা ঋণ করে চলতে হচ্ছে। আর সেই ঋণ শোধ করতে গিয়েই হচ্ছে সংকট।’

 

এর আগে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে নীলফামারীর আশিকুর মোল্লা বাবু নামে একজন ব্যবসায়ী স্ত্রী ও দুই শিশুকন্যাকে হত্যার পর নিজে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। আশিকুরের চাচাতো ভাই জাকির হোসেন মোল্লা বলেন, ‘বাবার মৃত্যুর পর ব্যাংক থেকে নেওয়া ২২ লাখ টাকা ঋণ শোধ করতে গিয়ে আশিকুরের ব্যবসার পুঁজি শেষ হয়ে যায়। পাশাপাশি তিনি যে রাখিমালের ব্যবসা করতেন, সেখানেও বড় ধরনের লস করেছেন। তার গোডাউনে রাখা রসুন সব পচে গেছে। মানসিক বিপর্যয় থেকে তিনি এ কাজ করে থাকতে পারেন।’

 

সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, ‘আমাদের দেশটা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এখানে ধনীরা আরো ধনী হচ্ছে। গরিব আরো গরিব হচ্ছে। ব্যবসায়ী আশিকুর মোল্লার ন্যূনতম একটা সম্মানবোধ আছে। তিনি নীলফামারীর সদর উপজেলার চড়াইখোলা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ মোল্লার ছেলে। ফলে সম্মানবোধ থেকে তিনি হয়তো এ কাজ করেছেন। কিন্তু আমাদের দেশে তো হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণখেলাপি হয়ে অনেকেই আয়েসে জীবন যাপন করছেন। তাদের ঐ সম্মানবোধটাই নেই। এখন পরিস্থিতি যে পর্যায়ে গেছে, তাতে গরিব আরো গরিব হয়ে যাচ্ছে।’

 

অ্যামেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের একটি জরিপে জানা গেছে, ৮৭ শতাংশ অংশগ্রহণকারীর নিত্যকার জীবনের বেশির ভাগ মানসিক চাপের উত্সই হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। অনেকে ঋণ নিয়ে এই মানসিক চাপে পড়ছেন। এই মানসিক চাপ থেকে মুক্তি না পেলে দৈনন্দিন জীবন ক্রমশ হয়ে উঠবে আরো দুর্বিষহ। মনোবিদেরা বলছেন, নিজের মনোযোগ কিছুটা সরিয়ে আনার মাধ্যমে মানসিক চাপ থেকে তাত্ক্ষণিক মুক্তি মিলতে পারে।

 

গত বছরের মে মাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মুস্তাব আলী আত্মহত্যা করেন। ঋণের চাপ সইতে না পেরে শেষ পর্যন্ত তিনি আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। মুস্তাব আলীর ছেলে আহমেদ ওয়াসিফ প্রিতুল জানান, তার বাবা ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, ব্যুরো বাংলাদেশ, বীজ এনজিওসহ কয়েক জায়গা থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। সঠিক সময়ে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে ঋণের চাপ সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন।

 

গত সেপ্টেম্বরে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে মাসুদ আলম নামের এক যুবক ঋণের চাপ সহ্য না করে আত্মহত্যা করেন। কিশোরগঞ্জে লোকসানের কারণে ব্যবসা গুটিয়ে নেন রোকন উদ্দিন। ঋণে ছিলেন জর্জরিত। মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পেতে কিশোরগঞ্জ শহরতলির চরশোলাকিয়া এলাকার নিজ বাড়িতে গলায় ফাঁস দিয়ে নিজের জীবন শেষ করে দেন। এর আগে রাজশাহীর চারঘাটে মাছচাষি আবদুল কুদ্দুস এনজিও ঋণের চাপ সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেন। গত ৩০ আগস্ট কুমিল্লার তিতাসের কড়িকান্দি বাজারের কলা ব্যবসায়ী মোশারফ হোসেন এনজিও ঋণের চাপে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছিলেন মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার তাসলিমা আক্তার (৩৬)। কিস্তির জন্য চাপ দিয়েছিলেন কর্মকর্তারা। এতে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। এনজিওসহ নানা জনের কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন গাজীপুরের কাপাসিয়ার খোকন আকন্দ। পাওনাদারদের চাপ সইতে না পেরে গলায় ফাঁস দেন তিনি। এমন ঘটনা এখন প্রতিনিয়তই ঘটছে।

 

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন, ‘মানুষ অনেক সময় হতাশা থেকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। তবে সবাই একই ধরনের চিন্তা করেন না। হয়তো কোনো একটা সমস্যার কারণে এক জন আত্মহত্যার পথে গেলেন। আবার একই ধরনের সমস্যা আরেক জন অন্যভাবে সমাধান করছেন। এগুলো নির্ভর করে মানসিক চাপ কে কতটা নিতে পারছেন। কোনো পরিবারে যদি কেউ এ ধরনের হতাশায় ভোগেন, তাহলে দ্রুত মনোরোগ চিকিত্সকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। কারণ এ ধরনের মানুষ যে কোনো সময় যে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারেন।’

 

এনজিও ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে দেশীয় এনজিওর সংখ্যা ২ হাজার ৩১৮। এর মধ্যে অধিকাংশেরই আছে ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি। এ ছাড়া গ্রামে গ্রামে আছে মাল্টিপারপাস কোম্পানি; আছে নানা সমিতি ও দাদন ব্যবসায়ী। দেশের ৩ কোটি ৫২ লাখের বেশি পরিবার ক্ষুদ্রঋণ পরিষেবার আওতায় রয়েছে। ঋণ নেওয়ার পরের সপ্তাহ থেকে কিস্তি আদায় শুরু হয়। কৃষকের জমিতে ফসল ভালো না হলেও ঋণগ্রহীতাকে ঘরের গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, ঘটিবাটি বিক্রি করে সাপ্তাহিক কিস্তি পরিশোধ করতে হয়। যখন তাতেও কুলায় না, তখন ভিটেমাটি ও ঘর বিক্রি করতে হয়। এমনও বহু ঘটনা ঘটেছে যে, কিস্তি আদায়কারীরা ঋণের দায়ে ঋণগ্রহীতার ঘর ভেঙে নিয়ে গেছেন।

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘শহরে বিভিন্ন কাজের সুযোগ থাকলেও প্রত্যন্ত গ্রামে অসহায় দরিদ্র মানুষ সমস্যায় আছে। এ জন্য স্থানীয় প্রশাসনের উচিত এসব দাদন ব্যবসায়ীকে নিয়ন্ত্রণ করা।’