
নিজস্ব প্রতিবেদক:
৫ লাখ এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষকদের জমানো অবসর ও কল্যাণ তহবিলের টাকা অবসরের ছয় মাসের মধ্যে পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। অভিযোগ রয়েছে শিক্ষকদের এ টাকা পেতে বছরের পর বছর ঘুরতে হয়। অনেক সময় ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে এই টাকা প্রাপ্তি নিশ্চিত করা লাগে। এই অবস্থা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ১৩১ জন শিক্ষক-কর্মচারী হাইকোর্টে রিট করেন। এই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল বৃহস্পতিবার এ রায় দেন।
রায়ে হাইকোর্ট বলেছে, এটা চিরন্তন সত্য যে, রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট পেতে শিক্ষকদের বছরের পর বছর ঘুরতে হয়। এই হয়রানি থেকে তারা কোনোভাবেই মুক্তি পান না। প্রাথমিকের এক জন শিক্ষক কত টাকা বেতন পান, সেটা বিবেচনায় নিতে হবে। যেখানে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শিক্ষকদের প্রতি সহানুভূতিশীল, সেখানে অবসরভাতা সুবিধা পেতে শিক্ষকরা বছরের পর বছর দ্বারে দ্বারে ঘুরতে পারেন না। এজন্য শিক্ষকদের অবসরভাতা ছয় মাসের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। যাতে তারা হয়রানি থেকে মুক্তি পান।
এদিকে হাইকোর্ট রায়ে ৫ লক্ষাধিক শিক্ষক ও কর্মচারীর বেতনের ১০ ভাগ কর্তনের বিপরীতে প্রয়োজনীয় আর্থিক সুবিধা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছে। আদালত বলেছে, ১০ ভাগ কর্তন করলে সে পরিমাণ সুবিধা শিক্ষকদের দিতে হবে। শিক্ষকদের নিয়ে একেক সময় একেক ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা কাম্য নয়। রিটকারীদের পক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া রায়ের বিষয়টি সাংবাদিকদের জানান।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট প্রবিধানমালা, ১৯৯৯-এর প্রবিধান-৬ এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা প্রবিধানমালা, ২০০৫-এর প্রবিধান-৮ অনুযায়ী শিক্ষক ও কর্মচারীদের মূল বেতনের দুই ভাগ এবং চার ভাগ কর্তনের বিধান ছিল। যার বিপরীতে শিক্ষকদের ট্রাস্টের তহবিল থেকে শিক্ষক ও কর্মচারীদের কিছু আর্থিক সুবিধা প্রদান করা হতো। ২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল উল্লিখিত প্রবিধানমালাগুলোর শিক্ষক ও কর্মচারীদের মূল বেতনের দুই ভাগ এবং চার ভাগ কর্তনের বিধানগুলো সংশোধন করে তা চার ভাগ এবং ছয় ভাগ করে দুটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। এতে শিক্ষক ও কর্মচারীদের মূল বেতনের দুই ভাগ এবং চার ভাগ কর্তনের পরিবর্তে চার ভাগ এবং ছয় ভাগ কর্তনের বিধান করা হলেও উক্ত অতিরিক্ত অর্থ কর্তনের বিপরীতে শিক্ষক ও কর্মচারীদের কোনো বাড়তি আর্থিক সুবিধা প্রদানের বিধান করা হয়নি। অতিরিক্ত অর্থ কর্তনের আদেশ বাতিলের জন্য শিক্ষক-কর্মচারীরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় ২০১৯ সালে হাইকোর্টে রিট করা হয়। পরে সম্পূরক আবেদন দিয়ে ২০১৭ সালে করা আরও দুটি প্রজ্ঞাপনের বৈধতা নিয়ে রুল জারি করা হয়। সব রুলের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে গতকাল এ রায় দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত অবসর ও কল্যাণ সুবিধা ফান্ডে বেশির ভাগ টাকা জমা শিক্ষকরাই রাখেন। এখন সেই অর্থ পেতেও আড়াই থেকে তিন বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে তাদের। এই টাকা পাওয়ার জন্য বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্ট কার্যালয়ে নিত্যদিন ধরনা দিতে হচ্ছে শিক্ষকদের।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ জন শিক্ষক অবসরে যান। মাসে অবসর ও কল্যাণ ভাতার জন্য প্রায় ৮০০ আবেদন জমা পড়ে। কিন্তু একজন শিক্ষক মাসে ১০ শতাংশ হিসেবে এই তহবিলে যে টাকা জমা দেন, তা দিয়ে অবসরে যাওয়া সব শিক্ষককে অবসর ও কল্যাণ সুবিধার টাকা দেওয়া সম্ভব নয় বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান। এ কারণে আবেদনের স্তূপ জমা পড়ে আছে।
শিক্ষকদের এই ভোগান্তি লাঘবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হচ্ছে। বেসরকারি স্কুলের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বছরে ১০০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে। এই টাকার মধ্যে ৭০ টাকা অবসর সুবিধা ফান্ডে, বাকি ৩০ টাকা কল্যাণ ট্রাস্টের ফান্ডে জমা হবে। ভর্তির সময় বাধ্যতামূলকভাবে এই টাকা আদায় করা হচ্ছে। অবসর ও কল্যাণ ফান্ডে সরকার বিভিন্ন সময় সিড মানি দিয়ে আসছে। এতেও শিক্ষকদের ভোগান্তি দূর হয়নি। সারা দেশের এমপিওভুক্ত প্রায় ৫ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর ভাতা দেওয়ার কাজ করে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড ও বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট। এই বোর্ড ও ট্রাস্ট পরিচালিত হয় ২১ সদস্যবিশিষ্ট একটি পরিচালনা বোর্ডের মাধ্যমে। বোর্ডের চেয়ারম্যান শিক্ষাসচিব। শিক্ষকরা বলছেন, উচ্চ আদালতের রায়ে পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে। আমাদের আর হয়রানির শিকার হতে হবে না।