ই-পেপার | শুক্রবার , ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

চিংড়ির হোয়াইট স্পট ভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত

নিউজ ডেস্ক ,চট্টগ্রাম:

চিংড়ির ‘হোয়াইট স্পট সিনড্রোম’ভাইরাসের জিনোম বিন্যাসে নতুন ভ্যারিয়েন্ট সন্ধান পেয়েছেন গবেষকরা। সম্প্রতি প্রথমবারের মত এই ভাইরাস নিয়ে গবেষণায় এমন তথ্য খুঁজে পেয়েছেন তাঁরা। গবেষকরা বলছেন, দেশের রপ্তানি আয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত চিংড়ির ভাইরাস নিয়ে এ গবেষণার ফলে প্রতিষেধক তৈরি করা যাবে। এতে চিংড়ির উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি চাষীরাও অর্থিক ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে।

সাধারণত হোয়াইট স্পট সিনড্রোম ভাইরাসে আক্রান্ত হলে ৩-৭ দিনের মধ্যেই ওই স্থানের সব চিংড়ি মারা যায়। এ ভাইরাস মূলত চিংড়ির সাদা বৃত্তাকার দাগ সৃষ্টির জন্য দায়ী। এটি অত্যন্ত প্রাণঘাতী ও ছোঁয়াচে। এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে ঘেরের সব চিংড়ি এক সপ্তাহে মারা যেতে পারে। ভাইরাসটি চিংড়ির কোষে রেব সেভেন নামক যে রিসেপ্টর থাকে তার সহায়তায় কোষের ভেতর প্রবেশ করে এবং বিপাক প্রক্রিয়া ব্যবহার করে সংখ্যা বৃদ্ধি করে। যা চিংড়িকে দূর্বল করে ফেলে।

কক্সবাজার এবং সাতক্ষীরার বিভিন্ন চিংড়ির ঘের থেকে নমুনা সংগ্রহ করা গবেষণাগারে পরীক্ষা করা হয়। ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত চলা এই গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে চিংড়ির এ ভাইরাসের ১২৮০টি নতুন মিউটেশন (জিনের ভিন্নতা) হয়েছে। এর মধ্যে দুটি স্বতন্ত্র বা নতুন ভ্যারিয়েন্ট রয়েছে৷ যার নাম দেওয়া হয়েছে- বিডি_কক্স এবং বিডি_সাত। এই ভ্যারিয়েন্টগুলো ভারত, তাইওয়ান, থাইল্যান্ডের চেয়ে ভিন্ন এবং এর জিনোমিক গঠন অনেক বেশি স্বতন্ত্র।

গবেষণায় কক্সবাজার এবং সাতক্ষীরা অঞ্চলের ভাইরাসের জিনোমে ব্যাপক পার্থক্য দেখা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে জিনের এই ভিন্নতার কারণ দেশের আবহাওয়া, পানির বৈশিষ্ট্য, লবণাক্ততা ও ভৌগলিক অবস্থান। সাতক্ষীরার তুলনায় কক্সবাজারের চিংড়িতে এই ভাইরাসের প্রকোপ বেশি। আবার শীতকালের তুলনায় বর্ষাকালে (জুন-জুলাই) এর প্রকোপ বেশি।

সাধারণত এ হোয়াইট স্পট সিনড্রোম ভাইরাস ক্রাস্টাশিয়ান পর্বের প্রাণী গুলোকে আক্রমণ করে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। বিশেষ করে চিংড়ি, লবস্টার, কাঁকড়া পর্বের এসব প্রাণী বাদে অন্য কোনো পর্বের প্রাণী এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয় না। ক্রাস্টাশিয়ান পর্বের প্রাণীর কোষে আনুষঙ্গিক প্রোটিন হিসেবে রেব সেভেন নামক রিসেপ্টর থাকায় এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়।

গবেষণায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. এস এম রফিকুল ইসলাম ও অধ্যাপক ড. আদনান মান্নান এবং ইনস্টিটিউট অফ মেরিন্স সায়েন্সের অধ্যাপক ড. এস এম শরিফুজ্জামান এবং ড. শাহনেওয়াজ চৌধুরী ছাড়াও সহ প্রধান গবেষক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের ড. আনোয়ার হোসেন, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জুনায়েদ সিদ্দিকী ও আইসিডিডিআরবি’র বিজ্ঞানী এনায়েত হোসেন।

ইনস্টিটিউট অফ মেরিন্স সায়েন্সের শিক্ষক ড. শাহনেওয়াজ চৌধুরী বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশে বিরাজমান হোয়াইট স্পট সিনড্রোম ভাইরাসের প্রকরণ কেমন, এর জিনোম সিকুয়েন্সের মাধ্যমে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও ভিন্নতা সনাক্ত কর। এই ভাইরাসের কোন বিষাক্ত প্রোটিন বা জিন মাছের সংক্রমণ ও মৃত্যুর ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রাখে তার রহস্য উদঘাটন করা। এই গবেষণার ফলে চিংড়ি চাষীরা জানতে পারবে এই ভাইরাসের উৎস কি, কিভাবে ছড়ায়। এই তথ্যগুলো পরবর্তিতে প্রতিরোধ ব্যবস্থা পরিকল্পনায় ও প্রতিষেধক তৈরিতে মূল ভূমিকা রাখতে পারবে।

তিনি আরও বলেন, ভাইরাস মুক্ত চিংড়ি পোনা উৎপাদন ও মজুদের পাশাপাশি চাষ পদ্ধতির সকল স্তরে জৈব নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে পানির ভৌত ও রাসায়নিক গুনাগুন বজায় রাখতে হবে। প্রচলিত চিংড়ি চাষের পরিবর্তে আবদ্ধ পদ্ধতিতে আধা-নিবিড় চাষ করা হলে বাংলাদেশে বাগদা চিংড়ির উৎপাদন কয়েক গুণ বাড়ানো সম্ভব।

ইনস্টিটিউট অফ মেরিন্স সায়েন্সের অধ্যাপক ড. এস এম শরিফুজ্জামান বলেন, এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোন টিকা কিংবা প্রতিষেধক না থাকার তার নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব ছিল। জিনোম সিকুয়েন্সের মাধ্যমে এম আরএনএ ভিত্তিক টিকা বা এরকম কোন প্রতিষেধক চিন্তা করা যেতে পারে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল ইনফরমেশন (এন সি বি আই) এবং আমেরিকান সোসাইটি অফ মাইক্রোবায়োলজি কতৃক গৃহীত হয়ে এই জিনোম সিকুয়েন্সের তথ্য।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বাগদা চিংড়ি চাষ হয় কক্সবাজার ও সাতক্ষীরায়। ইতোপূর্বে সবচেয়ে বেশী সংক্রমণের হার ছিল এই দুই জেলাতেই যা মহামারী আকারেও রূপ নেয়। ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে এই ভাইরাস প্রথমবারের মত পরিলক্ষিত হয় কক্সবাজারের হ্যাচারিতে। ১৯৯৮ সালে খুলনা অঞ্চলের ৯০ ভাগ চিংড়ি হ্যাচারিতে এই ভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া যায়। ওই সালে চিংড়ি রপ্তানি ২৬ হাজার টন থেকে কমে ১৮ হাজার টনে নেমে আসে।