সালেহ আহমদ স’লিপক:
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় মণিপুরী সম্প্রদায়ের সর্ববৃহৎ প্রধান ধর্মীয় রাস উৎসব শ্রীকৃষ্ণের রাখাল নৃত্যের মধ্যদিয়ে শুরু হয়েছে। হাজার হাজার মানুষের পদচারনায় মূখর হয়ে উঠেছে মাধবপুর জোড়া মন্ডপ ও আদমপুর রাস উৎসব এলাকা।
সোমবার (২৭ নভেম্বর) পূর্ণিমা তিথিকে সামনে রেখে কমলগঞ্জের মাধবপুর ও আদমপুর এলাকায় মণিপুরীদের পৃথক দু’টি গ্রামে আয়োজন করা হয়েছে মহারাসোৎসব। এ উপলক্ষে উভয় জায়গায় বসেছে বিরাট মেলা। এলাকার পাড়ায় পাড়ায় বিরাজ করছে সাজ সাজ রব। কঠোর নিরাপত্তা ও ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে সকাল থেকে সীমান্তবর্তী এ উপজেলায় রাখাল নৃত্যের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় মণিপুরী সম্প্রদায়ের এ প্রধান ধর্মীয় উৎসব মহারাসলীলা।
মহারাসলীলা উপলক্ষে মাধবপুর শিববাজার জোড়া মন্ডপে মহারাসলীলা সেবা সংঘের আয়োজনে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সম্প্রদায়ের ১৮১তম এবং আদমপুরের তেতইগাঁও সানাঠাকুর মন্ডপে আদমপুর মণিপুরী কালচারাল কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে মৈতৈ মণিপুরী সম্প্রদায়ের ৩৮তম মহারাস উৎসব উপলক্ষে ছিল সাজ সাজ রব। সাদা কাগজের নকশায় সজ্জিত মন্ডপগুলো সাজানো হয়েছে নিপুন কারুকাজে।
রাসোৎসব উপলক্ষে দুপুর থেকে গোধূলীলগ্ন পর্যন্ত উভয়স্থানে চলে গোষ্ঠলীলা বা রাখালনৃত্য। সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও গুণীজন সংবর্ধনা এবং রাত ১০টা থেকে ভোর পর্যন্ত শ্রীকৃষ্ণের মহা রাসলীলার মধ্যে দিয়ে মঙ্গলবার শেষ হবে বৃহৎ এই ধর্মীয় উৎসব।
মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া ও মণিপুরী মৈতৈরা রাসোৎসব পৃথক পৃথক স্থানে আয়োজন করলেও উৎসবের অন্তঃস্রোত, রসের কথা, আনন্দ-প্রার্থনা সবকিছু একই। উৎসবের ভেতরের মূলকথা হচ্ছে বিশ্বশান্তি, সম্প্রীতি ও সত্যসুন্দর মানবপ্রেম। রাস উৎসব উপলক্ষে কমলগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। উৎসবে আগত ভক্তবৃন্দ ও আয়োজকরা জানিয়েছেন এবার তারা নিবিঘ্নে উৎসব উদযাপন করতে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত।
কমলগঞ্জ থানার ওসি সঞ্জয় চক্রবর্তী জানান, নির্বিঘ্নে মণিপুরী মহারাসলীলা উপলক্ষে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। উৎসব প্রাঙ্গণে স্থাপন করা হয়েছে পুলিশ কন্ট্রোল রুম।
উল্লেখ্য, ভারতের মণিপুরের রাজা ভাগ্যচন্দ্র মণিপুরে প্রথম এই রাসমেলা প্রবর্তন করেছিলেন। মণিপুরের বাইরে ১৮৪২ সালে কমলগঞ্জের মাধবপুরে প্রথম মহারাস উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। রাস উৎসবে সকালে গোষ্ঠলীলা বা রাখালনৃত্য হয়। গোধূলি পর্যন্ত চলে এই রাখালনৃত্য। রাত ১২টা থেকে শুরু হয় রাস উৎসবের মূলপর্ব শ্রীশ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলা অনুসরণ। মণিপুরীদের ঐতিহ্যবাহী নৃত্যের পোশাকে সজ্জিত হয়ে নেচে গেয়ে কৃষ্ণবন্দনায় ভোর পর্যন্ত চলে রাসলীলা। রাসনৃত্যে শ্রীকৃষ্ণ, রাধা ও প্রায় ৫০ জন গোপী থাকেন। গোপীদের সংখ্যা অনেক সময় কমবেশি হয়।
এই একটি রজনীকে কেন্দ্র করে মণিপুরীদের সংস্কৃতির এক বিশাল মিলন মেলায় পরিণত হয় উৎসব এলাকা। রাস উৎসবকে কেন্দ্র করে একমাস ধরে কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ও আদমপুরের মণিপুরী পাড়াসমূহে চলে প্রস্তুতি ও উৎসবের আমেজ। রং ছড়িয়ে মন্ডপগুলোকে সাজানো হয় নতুন সাজে।
রাসের দিন দুপুরে উৎসবস্থল মাধবপুরের শিববাজার উন্মুক্ত মঞ্চ প্রাঙ্গণে হয় গোষ্ঠলীলা বা রাখাল নৃত্য। রাতে জোড় মন্ডপে হয় রাসের মূলপ্রাণ মহারাসলীলা। রাস উৎসবে মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোকজনের পাশাপাশি অন্যান্য জাতি-ধর্মের হাজার হাজার লোক মেতে উঠে আনন্দ-উৎসবে। উৎসব উপভোগ করতে দেশের বিভিন্ন স্থানসহ ভারত থেকেও মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোকজন ছুটে আসেন।